ইয়াহিয়া মুখ খুলেছেন
নরঘাতক ইয়াহিয়া মুখ খুলতে শুরু করেছেন। পূর্ববাংলার আসল শরণার্থীদের তিনি ফিরিয়ে নেবেন। কিন্তু নকলদের নিয়ে কোন কারবারে তিনি ইচ্ছুক নন। এই নকলদের মধ্যে আছেন মুক্তিযােদ্ধা নামে দুষ্কৃতকারীরা এবং গৃহহীন পশ্চিমবাংলার ফুটপাথ বাসিন্দারা। তিরিশ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত রাজ্যগুলােতে। প্রতিদিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। ইসলামাবাদের প্রচারযন্ত্র ক’ সপ্তাহ আগেও বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থ শান্ত এবং তারা পাকিস্তানে স্বাভাবিক। শরণার্থী নামে যাদের জাহির করছেন নয়াদিল্লী তারা পাকিস্তানে অনুপ্রবেশকারী। সৈন্যদের তাড়া খেয়ে জমায়েত হয়েছে ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে। তাদের সঙ্গে জুটেছে ভারতীয় ফুটপাথ বাসিন্দারা। নয়াদিল্লী ওদের বলছেন—পূর্ববাংলার শরণার্থী। এতদিন শরণার্থীদের সবাই ছিলেন নকল। ইয়াহিয়া এখন তাদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন তিনটি শ্ৰেণী—আসল, নকল এবং পাক দুষ্কৃতকারী। ভারত সরকার তাদের সংখ্যা ফাপাচ্ছেন এবং দুনিয়াকে বিভ্রান্ত করছেন।
মনে হয়, ইয়াহিয়ার পিঠে পড়েছে আর্থিক খোচা। বাইরের সাহায্য প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না এলে হয়ত তাড়াতাড়ি আসবে না প্রত্যাশিত অর্থ। ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মজফর আমেদ ঘুরেছেন বৃটেন, আমেরিকা এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের দপ্তর। বিশেষ সুবিধা হয়নি। জনমতের চাপে বৃটিশ এবং মার্কিন সরকার কিছুটা ব্রিত। ইচ্ছা থাকলেও প্রকাশ্যে বেশী খাতির করতে পারছেন না ইয়াহিয়াকে। পূর্ববাংলার গণহত্যার খবর জেনে ফেলেছেন বিদেশীরা। রাষ্ট্রসঙ্রে সেক্রেটারী জেনারেল উ থাল্ট চারদিকে পাঠিয়েছেন সাহায্যের আবেদন। এই সাহায্য আসবে ভারতে। ব্যবহৃত হবে শরণার্থীদের সেবায়। বিভিন্ন বিদেশী ত্রাণসংস্থার প্রতিনিধিরাও দেখে গেছেন শরণার্থীদের অবস্থ। শুনেছেন তাদের মুখে পাক-সৈন্যদের বর্বরতার কাহিনী। মিথ্যাবাদী ইয়াহিয়া ধরা পড়ে গেছেন। আজ তিনি কবুল করেছেন, ভারতে আগত তিরিশ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আসল পাক-নাগরিকও আছেন। দাগী আসামী ইয়াহিয়া। ঘাড়ের উপর কনুই-এর প্রথম গুতাে পড়তেই আংশিক সত্য বেরিড়ে পড়েছে তার মুখ থেকে। আরও দু-চারটে এলােপাথারী ঘা পড়লেই গােটা সত্যিটাই তিনি বলতেন-গণহত্যা এবং ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা তিরিশ লক্ষ মানুষকে দেশ ছাড়া করেছে তার সৈন্যদল। তাদের বর্বরতা এখনও শেষ হয়নি। আরও শরণার্থী আসবেন ভারতে। বাংলাদেশের অবস্থা অশান্ত। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই চলছে। প্রশাসন বলতে কিছু নেই। পাশাপাশি চলছে দুটি সরকারের শাসন। শহর অঞ্চলে ঔপনিবেশিক পাক-শাসন এবং গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত এলাকায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শাসন।
ইয়াহিয়া খান যাদের দুষ্কৃতকারী বলছেন তারা করা? স্বাধীন বাংলাদেশ বাহিনী। তাদের সরকার পূর্ব বাংলার জনপ্রতিনিধি। ইয়াহিয়ার মত ভুইফোড় ডিকটেটর নন। ওরা গণহত্যায় হাত কলঙ্কিত করেন নি। তাদের লড়াই স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের। বিশ্বের অন্যতম নরঘাতক এদের বলছেন দুষ্কৃতকারী। কথাটি তিনি ধার করেছেন প্রাক্তন ঔপনিবেশিক প্রভুদের কাছ থেকে। তাদের দৃষ্টিতেও স্বাধীনতার সংগ্রামীরা ছিলেন দুষ্কৃতকারী? গত পঁচিশে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে পূর্ব বাংলায় নারকীয় তান্ডব। ইয়াহিয়া সব সময়ই বলেছেন—অবস্থা স্বাভাবিক। সৈন্যরা ক’ঘণ্টার মধ্যেই সব ঠিক করে ফেলেছে। এখন তিনি মত পাল্টিয়েছেন। তাঁর নিজের কথাতেই প্রমাণ হচ্ছে—অথবা কোনদিনই স্বাভাবিক ছিল না। অনেক নির্দোষ মানুষ অত্যাচারিত এবং বিতাড়িত হয়েছেন। নির্জলা মিথ্যা বলা যার অভ্যাস তার আশ্বাসের কোন দাম নেই। ইয়াহিয়ার মুখে রয়েছে মানুষের রক্তের স্বাদ। তাঁর খপ্পর থেকে যারা বেরিয়ে এসেছেন তারা ফিরতে পারেন না আবার সেই মৃত্যুফাঁদে। এদের প্রত্যাবর্তনের জন্য যে পরিবেশ দরকার, তা সৃষ্টির সাধ্য নেই ইসলামাবাদের।
বাংলাদেশের সমস্যা রাজনৈতিক। গণতন্ত্রের গলা টিপে মেরেছেন ইয়াহিয়া খান। চালু হতে দেননি তিনি সংখ্যাধিক্যের শাসন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব। পাক-চমুর উচ্ছেদ ছাড়া ফিরে আসবে না সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা। পশ্চিমী শক্তিগুলাে হয়ত ভাবছেন, একটি কনফেডারেশনের কথা। তা তৈরী করতে হলে প্রয়ােজন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বােঝাপড়া। আওয়ামী লীগই বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ইয়াহিয়ার দৃষ্টিতে এরা দুষ্কৃতকারী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী। মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ ছাড়া আর সবাই মুজিবর সমর্থক। রাষ্ট্রদ্রোহী গােটা বাংলাদেশকে অভয় দিচ্ছেন রাষ্ট্র-প্রেমিক ইয়াহিয়া। উন্মাদ ছাড়া এই নরপশুর কথার দাম কেউ দেবে না। বাংলাদেশের আসল সমস্যা নরখাদক ইয়াহিয়া। একে তাড়াতে না পারলে শরণার্থীদের মধ্যে আসবে না নিরাপত্তাবােধ এবং সাধারণ বাঙ্গালী পাবেন না স্বস্তি। ইয়াহিয়ার সাফাই অসহ্য। তাঁর মিথ্যার আড়ম্বর আকাশচুম্বী। ও’র জিবটা টেনে ছিড়ে না ফেলা পর্যন্ত ঘুচবে না সভ্য দুনিয়ার কলঙ্ক।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৩ মে ১৯৭১