পূর্ববঙ্গের জন্য খুনিদের এত দরদ কেন?
অমূল্যরতন সেন
পশ্চিম বাংলার সচেতন জনসাধারণ যদি অন্ধ কিংবা বধির না হন তবে মাত্র কয়েক বছর আগের ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-নাসুতিয়ন সামরিক জুন্টার ভয়াবহ নরমেধ যজ্ঞের কথা এই মুহূর্তে বিস্মৃত হবেন না। বিস্মৃত হবেন না জাকার্তার রাজপথগুলােতে স্তুপীকত গলিত শবদেহের কথা- ডােম ৩ অভাবে যে গলিত শবদেহগুলাে জাকার্তার আকাশ-বাতাস ভারি করে রেখেছিল এক বছরেরও বেশি, শকুনে শকুনে ছেয়ে ফেলেছিল সমস্ত জাকার্তার আকাশ আর রাজপথ। ঐ মৃতদেহগুলাের মধ্যে ছিল কর্নেল উনতুং থেকে সরল ও অন্ধবিশ্বাসী সাম্যবাদের পথিকরা, ছিল বহু সরল বিশ্বাসী প্রগতিশীল সােস্যাল ডেমােক্র্যাট, ছিল সাধারণ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং আইনজীবীর দল। দক্ষিণ জাভার জীবন্ত নরপিশাচ নাসুতিয়েনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সারা ইন্দোনেশিয়ায় দশ লক্ষ মানুষকে খুন করা হয় সি আই এ পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। তারপরই ইন্দোনেশিয়ার আকাশে দলে দলে শকুনের ভিড়। সেই শকুনের দলে সেদিন কারা যােগ দিয়েছিল?
এ হেন ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান সরকারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা কিন্তু তদানীন্তন- সুহার্তো-নাসুতিয়ন জোট। সেই নরহন্তারকের দল আজ পূর্ববাংলায় ইয়াহিয়ার নরমেধ যজ্ঞের নিন্দা করছে। নিন্দা করছে সােভিয়েত রাশিয়া- যারা ওয়রশ চুক্তির অজুহাতে চেকোশ্লোভাকিয়া এবং পােল্যান্ডে এই সেদিন দখলদারী ফৌজ পাঠিয়েছে। ইয়াহিয়ার নরমেধ যজ্ঞে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম-কম্পােডিয়া-লাওস-এ শতাব্দীর ঘৃণিত পৈশাচিক নরহত্যায় নিজে মেতে রয়েছে। আর ইয়াহিয়ার নরমেধ যজ্ঞের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু হুঙ্কার, আস্ফালন এবং জলসার হাট বসিয়েছে ভারত সরকার যে ভারত সরকার গণতন্ত্রের ঘােমটা পরে পুলিশ-গুণ্ডা মিলিটারি এবং এজেন্ট প্রভােকেটরদের সাহায্যে পশ্চিম বাংলার জনজীবনকে জংলি ব্রাসে ভরে দিয়েছে। পূর্ববাংলার রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে এই সমস্ত যােগাযােগ কি নিতান্তই আকস্মিক?
সাম্রাজ্যবাদ এবং সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ আর তার আন্তর্জাতিক গােলামের দল, খুনি সুহার্তো-নাসুতিয়ন জোট সহসা পূর্ববাংলার ব্যাপারে এতটা দরদী হয়ে উঠল কী কারণে? নরহত্যা আর লুণ্ঠনের সব সাধকরাই বা কেন সহসা আজ নরহত্যা আর লুণ্ঠনে বিচলিত হয়ে পড়ল? ঐ সব খুনী আর খুনের সাকরেদরা কি রাতারাতি সব সাধু হয়ে গেল?
যে কোনাে সামরিক ব্যাপারে তার রণনীতি ও রণকৈৗশল সম্পূর্ণভাবেই তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব রণনীতি এখন সুস্পষ্ট দুইটি ভাগে বিভক্ত। একটি অভ্যুত্থানমূলক, সামরিক বা অসামরিক কুপ-ধর্মী; অপরটি দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধমূলক, যা মূলত পিপলস ওয়ার। বিশ্ব রণনীতির এই দুই সুস্পষ্ট বিভাগ কোনাে আকস্মিক কারণে ঘটেনি, ঘটেছে বিশ্বরাজনীতির ঐতিহাসিক প্রবাহকে অনুসরণ করেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে মহান লেনিন ও স্তালিনের নেতৃত্বে সােভিয়েত ভূমির অভ্যুদয়ে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ পদানত জাতিবর্গের বুকে জ্বলে উঠেছিল স্বাধীনতার মশাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে মহান চীন ভূখণ্ডের মুক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলাে স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ-রণনীতি রণকৌশল। সত্তর কোটি চীনা জনগণ কুওমিন্টাঙ্গের বিশ্বাসঘাতকতা আর ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকে চুরমার করে, জাপানি আক্রমণকে বিধ্বস্ত করে মুক্তি অর্জন করল- যে মুক্তির পেছনে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব, নয়া গণতান্ত্রিক মাের্চা এবং জনযুদ্ধের প্লাবন।
ঔপনিবেশিক কিংবা নয়া-ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের যে কোনাে রূপই হােক না সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রকাঠামাের বিরুদ্ধে সামরিক কিংবা অসামরিক অভ্যুত্থানমূলক অভিযান চালিয়ে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না, কারণ সাম্রাজ্যবাদী সংগঠন এদিক থেকে অনেক বলশালী। সুকর্ণর নেতৃত্বে ইন্দোনেশীয় জনগণ ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদকে একদা ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল; কিন্তু স্বাধীনতা চলে গেল সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের হাতে সুহার্তো-নাসুতিয়নের হাতে, ইন্দোনেশিয়া মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবলিত হলাে নয়াউপনিবেশবাদী চক্রান্তে। কুখ্যাত কঙ্গোর যুদ্ধে নরপিশাচ শশাম্বে প্যাট্রিস লুমুম্বাকে যে পরাজিত করতে পেরেছিল তার কারণ পেছনে ছিল বেলজিয়ানদের মদদ। সাম্রাজ্যবাদ নিজেরই স্বার্থে ঐ অভ্যুত্থানকে পেছনের দরজা দিয়ে সাহায্য করেছিল। যদি সামরিক অভ্যুত্থানগুলােরই পরিণতি এ রকম হয় তবে অসামরিক অভ্যুত্থানগুলাের পরিণতি যে আরও ভয়াবহ হবে এবং এই সামরিক বা অসামরিক অভ্যুত্থানগুলাে যে সাম্রাজ্যবাদী শকুনদের প্রলুব্ধ করবে পূর্ববাংলার ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েত রাশিয়াসহ ভারতের গা টেপাটেপি তারই অভ্রান্ত প্রমাণ।
এ যুগে স্বাধীনতার যুদ্ধও জনযুদ্ধে পরিণত হতে বাধ্য। ভিয়েতনাম-কম্বােডিয়া-লাওস-এ এর জ্বলন্ত স্বাক্ষর রয়েছে। পূর্ববাংলার ন্যায়সঙ্গত স্বাধীনতা যুদ্ধ যাতে জনযুদ্ধে পরিণত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী শকুনদের নিরাশ করতে না পারে তার জন্যই সাম্রাজ্যবাদী জোটে ইয়াহিয়া বিরােধী নিন্দা ও আস্ফালনের জোয়ার বইছে।
সূত্র: দর্পণ
৩০.০৪.১৯৭১