You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৪ জানুয়ারি মুক্ত বাংলায় প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা

স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক এবং বিশ্বের নতুন মতবাদ মুজিববাদের পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যয়দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন, আমরা গণতান্ত্রিক পন্থায় বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। সুদীর্ঘ নয় মাসাধিক কালের রক্তাক্ত জনযুদ্ধে শত্রুমুক্ত জননী বাংলার শূণ্যকোলে ফিরে এসে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে অভিষিক্ত হবার পর শুক্রবার ঢাকায় আয়োজিত প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণদানকালে শেখ মুজিব এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি ডিক্টেটর হতে চাইনা, আপনারা এর প্রমাণ পেয়েছেন। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক পন্থায় আমরা বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করব- গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। শেখ সাহেব বলেন, পাকিস্তানে যে ৪ লক্ষ বাঙালি রয়েছে তাদের সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণ সজাগ এবং যেকোনভাবে হোক তাদের ফিরিয়ে আনবই। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান যে, স্বাধীন বাংলাদেশের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ চলছে। অতি শীঘ্রই নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে এবং অধিবেশনে এই খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হবে। রাজধানী ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে আয়োজিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে দেশি-বিদেশি তিন শতাধিক সাংবাদিক ও আলোকচিত্র শিল্পী যোগদান করেন। চিরাচরিত পোশাক পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন আনন্দ উৎফুল্ল পরিবেশে সাংবাদিকদের নিকট ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন তাঁর দুইপার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর এই সরকারি বাসভবনটিই ২৫ মার্চ পর্যন্ত ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবন আর এই প্রেসিডেন্ট ভবনে বসেই মার্চ মাসে মুজিব ইয়াহিয়ার ব্যর্থ- আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মাতৃভূমির স্বাধীনতার যুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। জননী জন্মভূমিকে স্বাধীন করার জন্য সকল শ্রেণীর জনগণ যে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাও তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতায় আমাদের দেশ ধ্বংস-স্তুপে পরিণত হয়েছে। পরিকল্পিত গণহত্যাযজ্ঞে ৩০ লক্ষ জীবন বিনষ্ট হয়েছে, লক্ষ লক্ষ বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ লোক বাস্তুত্যাগী হয়েছে। আর যারা দেশের মাটি আঁকড়ে থাকছে তাদের ওপর নেমে এসেছে অমানুষিক নির্যাতন ও লুটতরাজের বিভীষিকা। তার ফলে আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। তাই অর্থনীতি পুনর্গঠনই আজ সবচেয়ে জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, অবশ্যই অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করে শিক্ষাকে সকলের জন্য সুলভ করে তুলতে হবে। সাহায্য ও পুনর্বাসন তৎপরতা চালাতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। জাতির পিতা বলেন, ইয়াহিয়ার বর্বরতার সাক্ষর ভস্মস্তূপের ওপর নতুন সমাজের গোড়াপত্তন করতে হবে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি বলেন, সুদক্ষ পরিকল্পনা সংস্থা এই নয়া অর্থনীতির রূপরেখা নির্ধারন করবে। তিনি বলেন, দ্রুত এই রূপরেখা নির্ধারনের কাজ চলার পাশাপাশি সাহায্য এ পুনর্বাসন কর্মসূচীও গৃহিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বিশ্বের সকল রাষ্ট্র এবং স্বাধীনতাপ্রিয় জনগনের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য দানের জন্য বঙ্গবন্ধু ভারত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগনের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিও অনুরূপভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করায় বঙ্গবন্ধু পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশ এবং ফ্রান্স ও ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগন, জননেতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য জাতির জনক ভারত, ভুটান, জার্মান গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া এবং বার্মাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানান। পাকিস্তানের সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি আশা করি যেন ভুট্টো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিবেন। গণচীনের প্রতি পারস্পারিক সহযোগীতার পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, গণচীন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তাই তার উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া। হাইকোর্ট ও তার অধীন আদালতগুলি অবিলম্বে চালু করার উদ্দেশ্যে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি ও অযথা বিলম্ব পরিহারকল্পে বিচার ব্যবস্থার কতিপয় মৌলিক ত্রুটি সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন নীতি সযত্নে অনুসরণ করা হবে। তিনি বলেন, খসড়া শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু হয়েছে এবং অযথা কালক্ষেপন না করে গণপরিষদের অধিবেশন ডেকে তা পেশ করা হবে। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়সংকল্প জনগনের শক্তি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায়ের সংযোজন ঘটিয়েছে। আজ দারিদ্র, ক্ষুধা, অশিক্ষা, রোগ-ব্যাধি এবং সকল প্রকার শোষনের রাহুগ্রাস হতে জনগনকে মুক্ত করার জন্যও একইভাবে গনমুক্তি সুসংহত করতে হবে। ১৫
Reference:
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
ইত্তেফাক, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২
Unicoded by আরবিনা রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!