রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে দিন শরণার্থীদের
বন্যার স্রোতের মত শরণার্থী আসছেন। পেটরাপােল, বয়রা, হসনাবাদ এবং বসিরহাটে আর স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন রেজিষ্ট্রেশন দপ্তর। কত নাম লিখবেন তারা? জায়গাই বা দেবেন কোথায়? ভেঙ্গে পড়ছে সব ব্যাবস্থা। কলকাতার দিকে ছুটছেন শরণার্থীরা। লবণ হৃদ এলাকা জনাকীর্ণ। কাদার মধ্যে পড়ে আছেন হাজার হাজার নরনারী। পাকসৈন্য এবং ধর্মান্ধের দল করছে তাদের ভিটে ছাড়া। রাস্তায় সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে গুন্ডারা। যারা জান নিয়ে আসতে পেরেছেন তাদের শারীরিক বল একেবারে নিঃশেষিত। অনাহারে দীর্ঘ পায়ে হাটার শ্রম অনেকেরই সহনশীলতার বাইরে চলে গেছে। পড়ে আছে মৃতদেহের সারি। ক্যাম্পে যারা স্থান পাননি তারা উঠেছেন পরিচিতদের বাড়িতে। শরণার্থী এবং আশ্রয়দাতা সমভাবেই বিপর্যস্ত। মনে হয়, গােটা পশ্চিমবাংলায় শরণার্থীর সংখ্যা চল্লিশ লক্ষে ঠেকেছে। কোন কোন অঞ্চলে মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে কলেরা। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বহু রাজনৈতিক জল্পনা-কল্পনা করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। টালবাহানার আর সময় নেই। পশ্চিমবাংলা ধুকছে। অবিলম্বে শরণার্থীদের সরাতে হবে অন্যান্য রাজ্যে। সমস্যা সর্বভারতীয়। পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলাের উপর আর নির্ভর করতে পারেন না নয়াদিল্লী। শরণার্থী গ্রহণে অন্য রাজ্যগুলােকেও বাধ্য করা দরকার। তা না হলে ডুববে পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলাে এবং ডুববেন শরণার্থীরা।
শরণার্থী আগমনের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে গত ক’দিনে। ওদের মুখে যেসব কাহিনী শােনা গেছে তা ভয়াবহ। একমাত্র ধর্মান্ধ এবং পাক স্তাবক ছাড়া আর কারও থাকার সাধ্য নেই পূর্ববাংলায়। গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত বাড়ীঘর, জমিজমা এবং বিষয়সম্পত্তির দখল নিচ্ছে স্থানীয় শয়তানের দল। এ অবস্থা চলতে থাকলে শরণার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে। অন্যান্য রাজ্যে এদের পাঠাবার ব্যবস্থা না করলে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। এখনও তা আয়ত্তের মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ। পশ্চিমবাংলা সরকার আগেভাগেই কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। নয়াদিল্লীর গরিমসির শােচনীয় পরিণাম আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ত্রাণকর্মীরা দিশাহারা হয়ে পড়ছেন। শরণার্থীদের মাথার উপরে নেই কোন আচ্ছাদন। উন্মুক্ত আকাশের নীচে চলছে তাদের দুর্বিষহ জীবনযাত্রা। অনেকের ভাগ্যে রেশন জুটছে না। যাদের কপাল ভাল তারা চার পাঁচ ঘণ্টা লাইন দিয়ে পাচ্ছেন খাবার। রােগ প্রতিষেধক ওষুধগুলাে বাড়ন্ত। স্বাস্থ্যরক্ষার প্রাথমিক আয়ােজন বিপর্যস্ত। এই সম্ভাব্য সঙ্কটের জন্য তৈরী ছিলেন না কেন্দ্রীয় সরকার। বহু চেষ্টা করেও তাদের টনক নড়ান যায়নি। অন্যান্য রাজ্যে শরণার্থী পাঠাবার পরিকল্পনা পূবাহ্নেই তৈরী রাখার প্রয়ােজন ছিল। তা হয়নি বলেই সমস্যার জটিলতা অক্টোপাশের মত পূবাঞ্চলের রাজ্যগুলাের গলা চেপে ধরেছে। নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে যাবেন না নয়াদিল্লী। টাকার সঙ্কুলানটাই শেষ কথা নয়। আশ্রয়ের স্থানও দরকার। অন্যান্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার। তারপর বেশ ক’দিন চলে গেছে। এখন পর্যন্ত উচ্চবাচ্য করছেন না কর্তৃপক্ষ। এদিকে পশ্চিমবাংলার উপর চাপ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম। আর দ্বিধাসঙ্কোচ নয়। শরণার্থীদের অপর রাজ্যে পাঠাবার সর্বাত্মক আয়ােজন অবিলম্বে শুরু হওয়া একান্ত কাম্য। তা না হলে বাঁচতে পারবেন না লক্ষ লক্ষ ভাগ্যবিড়ম্বিত নরনারী।
আকাশ কুসুম কল্পনা করে লাভ নেই। দু’মাসের মধ্যে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। ইসলামাবাদের প্রভুত্ব বজায় রেকে স্থায়ী শান্তির কোন সম্ভাবনা নেই বাংলাদেশে। শ্রীমতী গান্ধী চান, পূর্ববাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। কিন্তু কে দেবে এই সমাধান? বাংলাদেশ সরকার এবং ভাসানী প্রমুখ নেতা একযােগে বলছেন, বিশ্বাসঘাতক এবং নরহন্তা ইয়াহিয়ার সঙ্গে কোন আপােষ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। এই সত্যের পূর্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চলবে না সংগ্রাম। বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়ার অস্তি ত্ব মুছে না ফেলা পর্যন্ত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পথ বন্ধ থাকবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিংহ যত খুশী বিশ্বপরিক্রমা করুন। তাতে সক্রিয় হয়ে উঠবে না বৃহৎ শক্তিগুলাে। বৃহন্নলা রাষ্ট্রসঙ্ঘ ফিরে পাবে না অর্জুনত্ব। পাকিস্তান ধরেই নিয়েছে যে, ভারত বলপ্রয়ােগ করবে না। শরণার্থীর বােঝা কাঁধে নিয়ে কেবল চেচামেচী করেই সে দিন কাটাবে। বৃহৎ শক্তিগুলাের মনেও এ ধারণা বদ্ধমূল। বাহুবল ছাড়া নয়াদিল্লীর অন্য কোন কার্যকর সম্বল নেই। এই বাহুবলের প্রয়ােগ ছাড়া ইসলামাবাদের বজ্জাতি কমবে না। বাংলাদেশ সরকারের সামনে এসে পড়েছে দুমুখী সংগ্রাম। একদিকে পাকসৈন্য এবং অপরদিকে তাদের সহায়ক সাম্প্রদায়িক দলগুলাে। অসামরিক ধর্মান্ধের দিনকতক ধরে ঠেঙ্গাতে পারলে এবং সুযোেগ পাওয়া মাত্র তাদের কোতল করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হয়ত খানিকটা আস্থার মনােভাব ফিরে আসত। মুক্তিযযাদ্ধাদের প্রস্তুতিপর্বে হয়ত সময় লাগবে। শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরাতে হলে ইয়াহিয়ার মাথায় দাড়া মারা আবশ্যক। এ কাজে যত দেরী হবে ভারতে শরণার্থীদের অবস্থানের মেয়াদও তত বাড়বে। বৃহৎ শক্তিগুলাে দা নিয়ে এগুবে না। জাতীয় স্বার্থ এবং মানবতার তাগিদেই ভারতকে সক্রিয়ভাবে দাঁড়াতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পাশে। বৃহৎ শক্তিগুলাে ইয়াহিয়াকে মানুষ করার ভার নিতে রাজী হলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু তারও একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা দরকার। অন্যথায় নয়াদিল্লীকেই খুঁজে বার করতে হবে আসল দাওয়াই। রাজনৈতিক প্রশ্নকেও ছাপিয়ে উঠেছে শরণার্থীদের প্রশ্ন। এখানে বিলম্বের অবকাশ নেই। এদের অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে দিন নয়াদিল্লী। লােকগুলাে বাঁচুক। তারপর ভেবে দেখুন ইয়াহিয়াকে নিয়ে তারা কি করবেন?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ জুন ১৯৭১