You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মওলানা ভাসানী

বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামের আজ আট মাস। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলেছে বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম। আজ প্রতিটি বাঙ্গালির মুখে একই কথার প্রতিধ্বনি “হয়-মৃত্যু নয় -মুক্তি” অর্থাৎ আপােষহীন সংগ্রামী-বাঙ্গালি জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র পথ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলাে আজ কোনাে মহল বাঙ্গালি জাতির এই অভিমতাকে উপেক্ষা করে তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বেশ উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে একটা সাধারণ প্রশ্ন উঠতে পারে রাজনৈতিক সমাধানটা কেন? আর কার সঙ্গে? যাদের অস্বীকার করে যাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা স্বাধীন বাংলা ঘােষণা করেছি স্বশস্ত্র সংগ্রামে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছি তাদের সাথে আপােষ। এ কেমন কথা? যেখানে লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী শবদেহের নিচে পাকিস্তানের কবর রচনা হয়েছে সেখানে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে অস্তিত্ব স্বীকার ব্যতীত কোনােরূপ আপােষ হতে পারে না। যদি আমাদেরও এ সংগ্রামে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিবর্গ সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে না আসেন তবে বাঙ্গালিরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থায় আপােষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। তবে এইটুকু আমরা আশা রাখি বিশ্ব-বিবেক অবশ্যই। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে অকপটে সাহায্য সহানুভূতি জানাবে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আট মাস অতিবাহিত হয়ে গেল, গত ৮ মাস ধরে বাংলাদেশের | সর্বস্তরের মানুষ অসীম সাহসিকতার সাথে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ে যাচ্ছে। জনগণের উপর শাসকগােষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংগ্রামে নিত্য-নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আরও উন্নত পর্যায়ে পৌছিয়েছে। আজ দিকে দিকে আওয়াজ উঠেছে “আপােষ নয়” চাই বাংলাদেশের পূর্ণ-স্বাধীনতা। বিগত ২৫শে মার্চ থেকে পাকফৌজ যে ধ্বংসলীলা চালায় তার ফলে লক্ষ লক্ষ মা-বােন সৰ্বস্ব হারিয়ে ও তাদের সন্তান ও ভাইদের সঙ্গে একাত্ম গড়ে তােলার মাধ্যমে ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনীর পরাজয়কে অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী করে তুলছে।  ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব-বাংলার উপকূল অঞ্চল গুলিতে তুলনাহীন ঘুর্ণীঝড় ও জলােচ্ছাসে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং কোটী কোটী টাকার সম্পত্তি ধ্বংস হয় । কশাই ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের অমার্জনীয় গাফিলতির জন্য সাহায্যদানে হৃদয়হীন ইচ্ছাকৃত অবহেলার পর পূর্ববাংলার জনগণ এক নতুন জীবন জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়েছে। জনগণের জীবনের এই নতুন উপলব্ধির ভাষা পায় তাদের সবচেয়ে নিকটতম মানুষ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর কণ্ঠে। ১৯৭০ সালের ২৩ শে। নভেম্বর ঐতিহাসিক পলটন ময়দানে দশ লক্ষ মুক্তিকামী জনতার সামনে ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন “স্বাধীন-সার্বভৌম পূৰ্ব্ব-বাংলা” প্রতিষ্ঠার দাবী। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি সন্তোষে [টাঙ্গাইল) অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানীর উক্ত দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানাে হয়। ১৯৭১ সালের ৯ই জানুয়ারি স্বাধীন সৰ্ব্বভৌম পূর্ব-বাংলার প্রতিষ্ঠার দাবীতে সন্তোষে (টাঙ্গাইল) মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। উক্ত সব্বদলীয় সম্মেলনে ন্যাপ, জাতীয় লীগ, জামাতে ওলামায়ে ছাড়া পূর্ব-বাংলার অন্যান্য দল অংশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। উক্ত সম্মেলনে, ন্যাপ, জাতীয় লীগ, জামাতে ওলামায়ের প্রতিনিধিদের লইয়া স্বাধীন-পূব্ব-বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমন্নয় কমিটি গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী উক্ত কমিটি আহবায়ক নিৰ্বাচিত হন। সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণ মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব-বাংলার দাবীর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। জানায়। ১৯৫৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কাগমারী টাঙ্গাইল জেলার সম্মেলনে মওলানা ভাসানী (পূর্ব-বাংলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) ঘােষণা করেছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও শােষক গােষ্ঠীর শোষণ পূর্ব বাংলার উপর যদি অব্যাহত থাকে তাহলে একদিন পূর্ব বাংলায় জনগণ কেন্দ্রকে ‘আচ্ছালামুআলাইকুম’ জানাবে। তার এই পূৰ্ব্বাহ্নের হুঁশিয়ারী আজ পূৰ্ব্ববাংলার জনগণের মনে স্বাধীনতার আকাথায় রূপায়িত হইয়াছে। মওলানা ভাসানী তিন বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন (যথা সম্রাজ্যবাদ, সামান্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজি) সহ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাড়েসাত কোটী বাঙ্গালিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। গ্রাম বাংলার আবালবৃদ্ধ বনিতা তাদের প্রিয় নেতার আহ্বানে সাড়া দিলেন। বাংলার সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত| [চলবে)

গণমুক্তি। ১:১১ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!