You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাড়ে সাত কোটি বাঙালির গণপ্রজাতন্ত্র বনাম একনায়ক জঙ্গীশাহী

জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় যে আমাদের সুনিশ্চিত তাতে আমাদের কোনােদিনই কণামাত্রও সন্দেহ ছিল। যদি তা থাকত তবে শুধু আজ নয়, বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে যখন পাকসৈন্যেরা চেঙ্গিস খাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের সর্বত্র ধ্বংস, হত্যা, আর নারী ধর্ষণের তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে তখন বাংলার অজেয় বীর সন্তানেরা প্রাণকে তুচ্ছ করে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে যেখানে যেভাবে পাক যুদ্ধযন্ত্রের ক্ষতিসাধন করা যায় তার প্রয়াস করেছে, করে সফল হয়েছে। কোথায় পেল তারা এই দুর্দমনীয় সাহস আর শক্তি। তাদের সাহস। আর শক্তি জুগিয়েছিল এই দৃঢ় প্রত্যয় যে, যে সােনার বাংলার স্বপ্ন তারা আজ বাইশ বছর ধরে দেখেছে, যার জন্য রক্ত দিয়েছে বারবার, সে আর আজ স্বপ্ন নয়। যেদিন শান্তির পথে বাংলার স্বাতন্ত্রের শেষ চেষ্টা পাকিস্তানের রক্তলিন্দু রাক্ষসেরা বাঙালির রক্তস্রোতে ডুবিয়ে দিল, যেদিন বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনের শপথ নিল, সেদিন বাঙালি জানল তার স্বপ্ন হল বাস্তব। | কিন্তু সেদিনও কেউ বিশ্বাস করে নি যে বাঙালিরা পারবে তাদের সঙ্কল্পে অটুট থাকতে । তারা ভেবেছিল। স্বাধীনতা ঘােষণা ও উজ্জ্বাসী বাঙালির একটা উচ্ছ্বাস ঢেউ এর মতাে উঠেছে, আবার ঢেউয়ের মতাে তলিয়ে যাবে। দেশে দেশে বাঙালি আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু কেউ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি। সবাই নিঃস্পৃহ দর্শকের মতাে চেয়ে চেয়ে দেখছিল কী হয়, কবে বাঙালি বার বার দ্বারে দ্বারে আঘাত হেনে সাড়া | না পেয়ে আবার তার প্রাক্তন অত্যাচারীদের দাসত্ব মেনে নেয়। 

কী হলাে? দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাঙালির পরাজয়ের যে আকুল প্রতীক্ষায় দিন গুণছিল, তা ঘটল , ঘটল না। ঘটল তার বিপরীত। স্বাধীনতা ঘােষণা হয়েছিল ২৬শে মার্চ, বিদেশী রাষ্ট্র দ্বারা তার প্রথম স্বীকৃতি হল ৬ই ডিসেম্বর। | এই ঐতিহাসিক ঘটনা মনে রাখবে সবাই। আমরা বলি বিশ্ববাসী আপনারা এও মনে রাখবেন, এই দীর্ঘদিনের প্রতিদিন, প্রতিরাত্রি, প্রতি মুহূর্ত অতন্দ্র বাঙালি যােদ্ধারা এই ঘটনার একটি একটি পরমাণু সৃষ্টি করেছে, সঞ্জীবিত করেছে, প্রাণচঞ্চল করেছে, সংহত-সম্বন্ধ করেছে। আর প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি লােকের সঙ্গে তাদের একান্ত, আন্তরিক একাত্মবােধ। তারা শুধু দিয়েছেই। তাদের রক্ত, তাদের প্রাণ, তাদের ধ্যান জ্ঞান, নানা আকাক্ষা সব কিছু। তারা চায় নি কিছুই, অর্থ, মান, প্রতিপত্তি। বিশ্ববাসী, এই যােদ্ধারা যারা শুধু সেই রণাঙ্গনেই সীমাবদ্ধ নেই, যার সংবাদ আজ আর আপনাদের অজানা নয়, এই যােদ্ধারা ছড়িয়ে আছে সর্বত্রতাদের কতকজনের নাম আপনারা জানেন? অথচ তারাই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবদেহের অসংখ্য নামহীন রক্তকণিকা। তাদের সবার হাতে অস্ত্র ও নেই, তবু তারা লড়েছে, লড়াই। তাদের মধ্যে পুরুষ আছে, নারী আছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক ও আছে, যারা প্রাণ বিপন্ন করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য না দিলে মুক্তি সৈনিকদের আঘাত এমন অমােঘ হতাে না। বিশ্বের জনগণ, তাদের অভিবাদন করুন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় নি। এখনও পাক হানাদার বাংলাদেশের বুকে লুকিয়ে আছে । মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় নি; পাক ও আরও নানা সাম্রাজ্যবাদী শােষণের ফলে বাংলাদেশের যে অপরিসীম দারিদ্র্য তার বিলুপ্তি না হােলে। কোথায় মুক্তি। তাই প্রত্যেকটি বাঙালিকে আজ লড়তে হবে-রণক্ষেত্রে, ক্ষেতে খামারে, মুক্ত অঞ্চলের।  কারখানায়, বাগানে গঞ্জে, পুনর্জাগ্রত বাঙালি ভাঙা দেশ আবার গড়বে, দ্বিগুণ পরিশ্রমে এবং অব্যাহত থাকবে তার সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে জেহাদ। জয় বাংলা, যে বাংলা শােষণকে চিরতরে কবর দেবে, সাম্য প্রগতি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করবে। ইতিহাসে রাখবে এক নতুন দৃষ্টান্ত।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ১:১৭ ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!