You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৈত্রী - সংগ্রামের নোটবুক

গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৈত্রী

মনে হইতেছে, অনেক শব্দের যথাযথ অর্থ আমাদের জানা নাই। বিশেষ করিয়া বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর হইতেই যে শব্দের যে অর্থ হওয়া উচিত, কিংবা আমাদের যাহা জানা ছিল তাহা বাস্তবের সাথে ঠিক মিলিতেছে না। কথাটি আরও ব্যাখ্যা করিয়া বলা দরকার। বিশ্ব রাজনীতির বৃহৎ শক্তির বিশেষ ভূমিকা রহিয়াছে। ছােট বড় সব রাষ্ট্রেরই আইনগত অধিকার সমান হইলেও ক্ষমতা অনুযায়ী প্রভাব ইহাদের বেশি। ইহারা নিজেদের রাজনীতি তথা অর্থনীতি সমূহের একেকটি নাম দিয়াছে । কথা হইতেছিল ঐসকল নাম লইয়া।। আমেরিকা দাবী করে তাহার নীতি শুদ্ধ গণতান্ত্রিক; চীন বলে যে সমাজতান্ত্রিক; এদিকে সােভিয়েত ইউনিয়নকেও বলা হয় সমাজতান্ত্রিক দেশ। যতদূর জানি গণতন্ত্র কথাটার তাৎপর্য রাজনৈতিক; সমাজতন্ত্র মূলত অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি আদর্শবিশেষ। গণতন্ত্রের মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারসমূহ-যেমন, বাকস্বাধীনতা ও ভােটাধিকার ইত্যাদি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সমাজতন্ত্র মানুষকে অর্থনৈতিক শােষণ। হইতে মুক্ত করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, মানুষর দ্বারা মানুষের উপর যতরকম রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অবিচার ও উৎপীড়ন, তাহা একমাত্র অর্থনৈতিক শােষণের ভিত্তি ভূমির উপরই দণ্ডায়মান। সেহেতু সত্যিকার সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রও নিহিত থাকে। | আমেরিকায় সমাজতন্ত্র নাই। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকার চিরাচরিত যুদ্ধ ঘােষণার কথা কে না জানে। তথাপি মার্কিনী অপ্রচারের বদৌলতে অনেকের একটা ধারণা জন্মিয়াছিল, হয়ত সেই দেশে গণতন্ত্র আছে কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার উলঙ্গ গণবিরােধী ভূমিকা দেখিয়া তাহারা নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে আসিবে যে, হয় আমেরিকা মিথ্যাবাদী, নতুবা গণতন্ত্র ইহাকেই বলে। আমরা বলিতে চাই, শেষােক্ত অনুমানটি ভুল নহে। কারণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সহিত সংশ্লিষ্ট না থাকিলে নির্ভেজাল গণতন্ত্রের ইহাই চেহারা। | গণচীনের ভিতরের খবর বাইরের পৃথিবী খুব কমই জানিতে পারে। পিকিং বেতারে যে সকল গালিগালাজ শােন যায় এবং পিকিংয়ে প্রকাশিত যেইসব বিপ্লবী পুস্তকাদি পাওয়া যায়, তাহাতে অবশ্য না বুঝিয়া উপায় নাই যে, চীন একটি বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দেশ; শােষিত, অনুন্নত জাতি এবং সর্বহারার সংগ্রামে সর্বত্রই তাহার সমর্থন উন্মুক্ত। কিন্তু এইবার আমাদের একটু খটকা লাগিয়াছে এইজন্য যে, বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে চীন পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া অভিহিত করিয়াছে, মুক্তিযােদ্ধাদেরকে বলিয়াছে, দুষ্কৃতকারী, তদুপরি সম্প্রসারণবাদী’ ভারতকে দিয়াছে হুমকি।

চীনের আভ্যন্তরীণ বিষয় যতটা জানা যায় তাহাতে দেখি, ব্যক্তিপূজাই চীনা নীতির বিশেষত্ব। ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতে গিয়া লিও শাউচির ন্যায় অসংখ্য সৎ ও প্রবীণ কমিউিঃ মাও সেতুংয়ের নিজস্ব বাহিনী ‘লাল রক্ষী’দের হাতে লাঞ্ছিত । লাল রক্ষীরা চীনের সবচেয়ে সুবিধাভােগী একটি দল। মাও তাহার চীনা সমাজতন্ত্রকে টিকাইয়া রাখিবার জন্য উহারা যে কোনাে কাজ করিতে পারে। মাওয়ের এই বাহিনী তাহার দুর্বলতারই পরিচায়ক। নিশ্চয়ই সনা অর্থনীতিতে এমন কোনাে ত্রুটি রহিয়াছে যাহা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ হইতে কঠোর সমালােচনার যােগ্য; এবং এই সমালােচনাকে মাওসেতুং ভয় পান বলিয়াই সেইখানে গণতন্ত্র পর্যন্ত। সুতরাং ইহাই প্রমাণ হয় যে, আমেরিকার সমাজতন্ত্রহীন গণতন্ত্র যেমন একটি ভাওতা, তেমনই চীন-এর গণতন্ত্রহীন সমাজতন্ত্রও একটি উঁওতা। উভয়দেশের নীতিই প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ। আজ গণচীন ও আমেরিকা যে বিশ্ব-রাজনীতিতে হাতে হাত মিলাইয়াছে তবু নূতন হইলেও বিচিত্র কিছু নহে।

জাগ্রত বাংলা ১:৯ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০