অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি
ইয়াহিয়া হিটলারি কায়দায় যুদ্ধের আগে যথেষ্ট হুমকি এবং হম্বিতম্বি করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই মহাপ্রভুর কাছ থেকে অবারিত অস্ত্র পাবার ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে সত্যিসত্যিই এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে। ভারত আক্রমণ করে বসল। কিন্তু অস্ত্র দিয়েই শুধু যুদ্ধ হয় না, আসল শক্তি আসে যােদ্ধাদের ন্যায়বােধ, দেশাত্মবোেধ সর্বোপরি জনসাধারণের সমর্থনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান এগুলাের কোনােটিই পায় নি, তাছাড়া সামরিক বাহিনী একবার রাজনীতির আসরে নেমে পড়লে যুদ্ধ করার তেজস্বীতা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে ক্ষমতার দিকে ঝুড়ে পড়ে। গত এক যুগ ধরে শাসন ক্ষমতায় থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাতক অত্যাচারীই কেবল। হয়ে উঠেছে। এদিক থেকে আদর্শবাদী গণতান্ত্রিক ভারতের সেনাবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী। সেই কারণেই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানেও পাক সৈন্যদের পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে। | বাংলাদেশে গত ৮ মাস ধরে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ডভাবে মার খেয়ে জনগণের কাছ থেকে বৈরী আচরণ পেয়ে পাক সেনারা বিপর্যস্ত, অবসন্ন এবং ক্লান্ত। দীর্ঘ ৮ মাসের যুদ্ধে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের দমন করতে পারে নি বরং দিনে দিনে তা বেড়ে উঠেছে। যতদিন যাচ্ছিল পরাজয় আসন্ন হয়ে আসছিল। এ নিশ্চিত পরাজয়ের প্রতি সুদূর প্রসারী দৃষ্টি পাক জোয়ানদের না থাকলেও উৰ্দ্ধতন সামরিক অফিসারদের অনেকে তা অনুমান করতে পেরেছিল। জুন মাসের শেষের দিকে বিদেশী এক সাংবাদিকের সাথে আলােচনা প্রসংগে বাংলাদেশে উপ-পাক সামরিক অধিকর্তা স্বীকার করেছিল। ‘We are fighting a lost battle’ এ বক্তব্য শুধু মাত্র একটি জেনারেলের বক্তব্য নয়। হাজার মাইল দূর থেকে বিদেশে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে প্রতিটি পাক জোয়ান ও অফিসারদেরই আকুতি। নৃশংসতম আচরণ করে লােভ দেখিয়ে পাক বাহিনী জনগণকে তাদের দৃঢ়তা থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। ফলে তারা বাংলাদেশের আশা গোড়া থেকে ছেড়ে দিতেই শুরু করে। গত পনের দিনে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যুক্ত আক্রমণের মুখে পাকসৈন্যরা কোনাে বাধা না দিয়ে কেবল পশ্চাদপসরণ করে চলে। রুখে দাঁড়ালে এত কম সময়ে আমাদের এ বিরাট বিজয় সম্ভব হতাে না। কিন্তু আট মাস যুদ্ধে লিপ্ত ভাড়াটিয়া সৈন্যদের এ শক্তির মােকাবিলা করা অসম্ভব। তাছাড়া পাকসেনারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে জনগণের জন্য তারা যুদ্ধ করছে না। তারা যুদ্ধ করছে গুটি কয়েক সামরিক জেনারেলদের জন্য। জনগণ কর্তৃক ঘৃনিত হচ্ছে ফলে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা মনােবল কোনােটাই তারা পাচ্ছে না। কাজেই তারা পশ্চাদপসরণ করে বাচার পথ নেয়াটাই সমীচিন মনে করেছে। | বড় বড় প্রভুরা ভয় দেখিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে রাষ্ট্রসংঘের হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে পাকিস্তানকে এ থেকে মুক্ত করবে এ সম্ভাবনাও এখন সূদুরপরাহত। | কেননা ন্যায়বােধ ও আত্মবিশ্বাসে অটুট ভারত বাংলাদেশ এ দুটি বৃহৎ রাষ্ট্রের হুমকিতে ভীত নন। কারণ তারা জানেন বৃহৎ শক্তি সােভিয়েট রাশিয়া ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা তাদের পাশেই আছেন। এ সমস্ত ঘটনার আলােকে এটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল যে এই প্রাণভয় এবং বাঁচার আশাতেই হয়ত অবরুদ্ধ সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে। তাছাড়া নিশ্চিত এ পরাজয়কে যে এড়ানাে সম্ভব নয়। তাদের বিষদাঁত যে উপড়ে গেছে সেটা তারা নিজেরাও উপলব্ধি করেছে। কার্যতও তারা তাই করেছে, প্রাণ নিয়ে বাঁচবার জন্য বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর হাতে।
অভিযান ॥ ১: ৪ ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০