You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.09 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | —নইলে সমস্যাপীড়িত জাতিই সরাসরি আঘাত হানবে | শ্লোগানই যথেষ্ট নয় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৯ই মার্চ, শনিবার, ১৯৭৪, ২৫শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

—নইলে সমস্যাপীড়িত জাতিই সরাসরি আঘাত হানবে

ঐতিহাসিক সাতই মার্চ এবার অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান সূচীর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেলো। বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবার দেশবাসীকে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া দিয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যেও অত্যন্ত আবেগ এবং বীরত্বের অতীতকে স্মরণ করে দিয়ে গেছে সাতই মার্চ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী যুবলীগ সাতই মার্চ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা ও যুবলীগের জনসভায় বিভিন্ন বক্তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর মতামত ব্যক্ত করেছেন। উভয় সংগঠনের পক্ষ থেকেই অনতিবিলম্বে একটি কার্যকরী ও বাস্তব কর্মসূচী নিয়ে দুর্নীতিবাজ, প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজবিরোধী ও মওজুতদার-মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার উপরও উভয় সংগঠন গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আওয়ামী যুবলীগের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এ ব্যাপারে অভিমত পোষণ করা হয়েছে। তাদের মতে, আর বিলম্ব নয়—এখনই সমাজবিরোধী শক্তি সমূহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী ও হঠকারী বামপন্থীরা আজ মিলিতভাবে যে অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানার সময় এসে গেছে। যারা বঙ্গবন্ধুর নাম ধরে অশোভন মন্তব্য করবে তাদের বিরুদ্ধেও প্রত্যক্ষ আঘাত হানা হবে। মওজুতদার, মুনাফাখোর ও চোরাকারবারীরা আজ যে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করেছে—তাদের সঙ্গে আর আপোষ নেই, এবার তাদেরকে সরাসরি আঘাত হানতে হবে। যুবলীগের চূড়ান্ত ঘোষণা : যেখানে আঘাত করলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য কমবে সেখানেই আঘাত করা হবে। যারা ঘেরাও অভিযানের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে, যারা নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালাচ্ছে, যারা খুন, গুপ্তহত্যায় লিপ্ত হয়েছে—যুবলীগ তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযান পরিচালনা করার কথাও ব্যক্ত করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
এবারের সাতই মার্চের জনসভা জাতিকে একটি নতুন বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করাতে সক্ষম হয়েছে। বিষয়টি হলো : স্বাধীনতার পর থেকে আজ প্রায় দু’বছর হতে চললো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে কিন্তু তা বাস্তবে ফলপ্রসূ হয়নি। গত দু’বছরের আইনের শাসন জাতিকে দ্রব্যমূল্যের ক্রম আক্রমণ থেকে রেহাই দিতে পারেনি। যদি এটাই সত্য হয় তাহলে যে ব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্য কমবে এবং বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার তৎপরতা বন্ধ করতে বাধ্য হবে সেই ব্যবস্থার আজ আশু প্রয়োজন। দেশের কোটি কোটি মানুষকে অর্ধাহারে অনাহারে ও সন্ত্রাসী তৎপরতার দরুণ আতঙ্কিত রেখে জাতি আজ আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে—এই সোনার সম্ভাবনার দিকে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে পারেনা। এবার তাই প্রয়োজন সেইখানে প্রত্যক্ষ আঘাত হানা যেখানে আঘাত দিলে দাম কমবে, সন্ত্রাসীরা সন্ত্রস্ত থাকবে, প্রতিক্রিয়াশীল ডান ও হঠকারী বামপন্থী মাথা গুটাবে। বাংলাদেশের নিরীহ শান্তিকামী জনগণের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আজ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অবকাশ নেই। আমরা লক্ষ্য করছি, গত কয়েক মাসে দেশের অভ্যন্তরের সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ সীমাহীন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। এবং তারা বিভিন্ন উপায়ে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পৃত্ক্ত রয়েছে দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। যার দরুণ জনজীবন আজ মৃত্যুন্মুখ হয়ে উঠেছে। আমাদের সরকার এ সকল কর্মকান্ড দেখে মাঝে মাঝে গোস্বাও হয়েছেন আবার মাঝে মধ্যে চুপচাপ অবলোকন করেছেন। যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দকে এ সকল তৎপরতা বিবেকের কষাঘাত করেছে। আর তাই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত ৭ই মার্চের জনসভা ও আলোচনা সভায়। নেতৃবৃন্দের এই বিবেকের কষাঘাত গোটা জাতির মনে রেখাপাত করেছে বলে আমরা মনে করি। আমরা বিশ্বাস করি—দেশের বর্তমান নাজুক অবস্থার বাস্তব মোকাবেলা করতে না পারলে দুঃসহ কষ্টে জর্জরিত মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সকল ক্ষমতা বা অধিকার ক্ষমতাসীন নেতাদের একদিন হারিয়ে ফেলতেই হবে। বিশেষ করে যে সকল কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতিমূহূর্তে বাড়ছে তার ছিদ্রপথ আজ বন্ধ করতেই হবে। যদি এ সকল নাজুক পরিস্থিতির মোকাবেলার ব্যাপারটি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার আওতার মধ্যে থাকে আর তা মোকাবেলায় তারা অসমর্থ বা শৈথিল্য প্রদর্শন করেন তাহলে জাতির সামনে জবাবদিহি করতেই হবে। যারা এই জবাবদিহিতে রাজী নয় আজ তারাই প্রত্যক্ষ আঘাত হানার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিবেচনা করছে। কেননা, এ জাতি বড় আশা নিয়ে ক্ষমতায় সমাসীন করেছিল এ সরকারকে, অহেতুক কিছু সমস্যার মোকাবেলায় ব্যর্থতা দেখার জন্য নয়। জাতি তাই আবার সংগ্রাম চায় এবং তা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।

শ্লোগানই যথেষ্ট নয়

বাংলার অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে কৃষি উন্নয়নের সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি ক্ষেত্রে যদি উন্নতি সাধিত না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও আমাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। কৃষি ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকার তাই সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিলেই তো আর রাতারাতি দেশের কৃষি ব্যবস্থার চেহারা পরিবর্তিত হবে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য শুধু সবুজ বিপ্লব সাধনের শ্লোগান উচ্চারণ করাটাই যথেষ্ট নয়। সবুজ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত এবং সাফল্যমন্ডিত করার জন্য বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করা উচিত। সরকার সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন দীর্ঘদিন গতায়ু হয়ে গেলো। এই সময়ের মধ্যে বাংলার কৃষি ক্ষেত্রে যতটুকু উন্নতি সাধিত হয়েছে তা একবার তলিয়ে দেখলেই দেশের কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতি-অবনতির একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে। সবুজ বিপ্লব ভেস্তে যেতে বসেছে, এই বাক্যটি উচ্চারণ করলেই কৃষিবিভাগীয় সরকারী কর্মকর্তারা আপত্তি জানাবেন। কিন্তু দেশের বিভিন্নাঞ্চল থেকে কৃষি ক্ষেত্রের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার যে সব খবরাখবর নিত্যদিন খবরের কাগজের পাতাগুলোতে পত্রস্থ হয়ে চলেছে, তা থেকে আমাদের মনে এহেন ধারণার জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক যে, দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার যতোই সবুজ বিপ্লব ঘোষণা করুন না কেন, তাতে কৃষি ক্ষেত্রের কোনো উন্নয়ন হবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে হয়েছেও তাই। যতোই দিন যাচ্ছে আমরা অবাক বিস্ময়ে তাতোই সবুজ বিপ্লব বিঘ্নিত হওয়ার নতুন নতুন খবর পাচ্ছি। এই সব খবর দেখে স্বাভাবিক কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। পানি সেচের অভাবে দেশের বিস্তীর্ণ জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই পানি সেচ প্রকল্প এতোই মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে যে, পানির অভাবে বহু জমি আবাদ করাও সম্ভব হচ্ছে না। অথচ আমাদের এমনই অবস্থাকে সামনে রেখে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখতে পারিনা। কৃষকদের ভাগ্যের ফেরই বলতে হবে, নইলে কোথাও পানির অভাব আবার কোথাও বা পানি নিষ্কাশনের সমস্যা দেশের কৃষককূলকে এতো প্রকটভাবে ভোগাবে কেন? ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাওর এলাকা পানি সেচ সংকটের কবলে পড়ে হাজার হাজার একর জমিতে কোনো রকম ফসল উৎপন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো এলাকায় যাও একটা কি দু’টো ক্ষীণ খাল ছিল, তাও ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। অভিযোগে জানা যায় যে, কৃষি বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এসব ব্যাপার অবগত করানোর পরও কোনো ফলোদয় হয়নি। জমিগুলো এখন মরুভূমির শূন্যতার হাহাকার নিয়ে অনাবাদী পড়ে আছে। অন্য এক খবরে জানা যাচ্ছে যে, সমগ্র সিলেট জেলায় নাকি সবুজ বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। কৃষি যন্ত্রপাতি বন্টন ব্যবস্থার জটিলতা এবং ক্রুটির ফলেই এই সংকটের সূত্রপাত হচ্ছে। গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং পাওয়ার পাম্প বিতরণের ক্ষেত্রে নাকি কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচীকে বিঘ্নিত করে চলেছে। জানা গেছে, ৩২টি থানা সম্বলিত সমগ্র সিলেট জেলার জন্য কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের নলকূপ বিভাগে অন্যূন ১৬ জন সেকশন অফিসার থাকার কথা। অথচ বর্তমানে নাকি মাত্র ৬ জন অফিসার রয়েছেন। এই অবস্থায় আর যাই করা যাক না কেন, সবুজ বিপ্লবকে সাফল্যমন্ডিত করা যাবেনা। দেশের খাদ্য ঘাটতিও এমনি করে পরিপূরণ হবার নয়। তাই বলছিলাম, সক্রিয় এবং বাস্তব ব্যবস্থা অবলম্বিত না হলে, সহজ পন্থায় কৃষকদের নিকট কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেয়ার বন্দোবস্ত না করা হলে, সবুজ বিপ্লব একটি শ্লোগান হিসেবে প্রতিপন্ন হবে। কৃষকদের সমস্যার সমাধানকল্পে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে আরো সক্রিয় হতে হবে। নইলে সরকার ঘোষিত সবুজ বিপ্লব শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য হবে বলেই আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন