নষ্টামির উৎস সন্ধান
সরকার আমাদের মাটির ডেলা। কেহ বলেন, ত্রিপুরায় সরকার বলিতে কিছু আছে কি? কেহ বা বলেন, এখানে প্রশাসন নামে কিছুই নাই। আমরাও বলিয়াছি অপদার্থ সরকার। আজ দেখিতেছি ত্রিপুরা সরকার থাকা না থাকার ধার ধারে না, প্রশাসন (প্রকৃষ্ট+শাসন), অশাসন, কুশাসন (কুশ দ্বারা তৈরি আসন নহে) প্রভৃতির মায়ামমাহ মুক্ত, পদার্থ অপদার্থতার অতি উর্ধ্বে নির্বিকার পরম পুরুষ সদৃশ একটা শক্তি স্বীয় মহিমায় অস্তিত্ব জাহির করিতেছে। জাহির করিতেছে না বলিয়া বজায় রাখিতেছে বলিলেই বােধহয় ঠিক হয়। যাহারা মনে করেন সরকার নাই, এই সরকার তাহাদিগের নিকট যাইয়া এই আমি আছি’ প্রমাণ করিবার চেষ্টা করে না। প্রশাসন নাই’ বা ‘অপদার্থ’ প্রভৃতি নিন্দাবাদের প্রতিবাদও করে না ত্রিপুরা সরকার। ঋষিবাক্যটা স্মরণ করিতে হয়। দেবতাগণের স্বরূপ বর্ণনা হইল স্তুতি, আর মানুষের স্বরূপ কথন হইল নিন্দা। সেই ঋষিবাক্যই বােধহয় সার করিয়া বসিয়া আছেন আমাদের সরকার। ত্রিপুরার মাটি যেমন জলের ছিটাতে কাদা হইয়া যায়, আমাদের ত্রিপুরা সরকারও সমালােচনায় গলিয়া যায়।
শরণার্থী শিবিরসমূহে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কেহ আশা করে না, উহা সম্ভবও নহে। সামান্য একটা দশ পয়সাতে ক্ষুধা নিবারণ হয়ত চলে, আহার হয় না। ব্যারাকে বসবাস করিয়া আরাম বা আয়াসের স্বপ্নও কেহ দেখিতে পারে না। তবু কথা হইল, যাহা দেওয়া হইয়াছে তাহাই যদি সকলে আমরা সকলের তরে প্রত্যেকে আমরা পরের তরে মনােভাব লইয়া ব্যবহার করা হয় তবে বােধহয় অসন্তোষ বা বিক্ষোভ দানা বাঁধিতে পারে না। কোনাে কোনাে শরণার্থী শিবিরে পরিচালন ব্যবস্থায় শিবিরবাসীগণ সন্তোষ প্রকাশ করিতেছে। একই ধরনের অপরাপর শিবির পরিচালকদের সঙ্গে শিবিরবাসীদের মােটেই বনিবনা হইতেছে না। শিবিরবাসীর আতিথ্য ধর্মের অমর্যাদাকর ব্যবহার করিতেছে। অর্থাৎ কিনা শরণার্থীরা শিবির পরিচালকগণকে গালাগালি ও মারধরও করে বলিয়া সংবাদে প্রকাশ। সমপরিমাণ আর্থিক ব্যয় বরাদ্দে এক শিবিরে সন্তোষ অপর শিবিরে বিক্ষোভের সংবাদ ত্রিপুরা সরকার যথাযথভাবে পাইতেছে। কোনাে বিকার নাই; নির্বিকার চিত্তে শুভ এবং অশুভ বার্তা হজম করিতেছেন সরকারি মহাপ্রভুগণ। অবশ্য এ কথা। সুসংবাদে আনন্দে আত্মহারা হওয়া এবং দুঃসংবাদে বিচলিত হওয়া প্রাজ্ঞের ধর্ম নহে। প্রাজ্ঞতার দাবিও ত্রিপুরা সরকার করিতে পারে না! যদি ধরিয়াও লওয়া যায় যে, ত্রিপুরা সরকার প্রাজ্ঞ তখনই প্রশ্ন আসে অশুভের প্রতিকার প্রতিবিধান কি প্রাজ্ঞের মূল ধর্ম নহে? অতিথি বৎসল ত্রিপুরা অতিথি আপ্যায়নের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে। অপরিমেয় ক্ষয়-ক্ষতির বােঝা ঘাড়ে করিয়া ত্রিপুরার অধিবাসীগণ ভারত সরকারের তথা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মানবতার ব্রত উদযাপনে আগাইয়া আসিয়াছে। এমতাবস্থায় যদি অতিথিগণ অসন্তোষ ও বিক্ষোভ প্রকাশ করেন তবে কি সমগ্র ত্রিপুরাবাসীর নাক, কান কাটা যায় না? কেন এমন হইবে? দায়ী কে?
জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জটিলতা ভেদ করিতে হইলে সর্বাগ্রে ত্রিপুরা সরকারকেই আগাইয়া আসিয়া মাথা ঘামাইতে হয়। প্রথমে অনুসন্ধান করিতে হইবে শরণার্থীদের অভিযােগ কী। দ্বিতীয় তদন্তক্রমে আবিষ্কার করিতে হইবে শিবির পরিচালকগণ (সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারী অথবা স্বেচ্ছাসেবগণ) বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার করিতেছেন কিনা। তৃতীয় সুচতুর, সুচারু ও অভিজ্ঞ গােয়েন্দা নিয়ােগ করিয়া খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে অতিথির ছদ্মবেশে ইয়াহিয়ার এজেন্ট বা দালালরা ভারতের মানবতা মহাব্রত বানচাল করিবার উদ্দেশে সক্রিয় কিনা। ইদানিং পাক বেতারে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে অমানবিক কাণ্ডকারখানার কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করা হইতেছে। মিথ্যা কল্পনাকে কথঞ্চিত বাস্তব রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা পাকজঙ্গি সরকার অবশ্যই করিতেছে বলিয়া আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এই কাজে বাংলাদেশের নেতাগণের সক্রিয় সহযােগিতা একান্ত আবশ্যক। চতুর্থ চালাইতে হইবে গবেষণা ও তদন্ত। ইহার মূলে নাশকতামূলক রাজনৈতিক চক্রান্ত আছে কিনা। ভারতের গণতন্ত্রকে সমূলে ধ্বংস করিবার জন্য দেশের বাহিরে ভিতরে শত্রুর অভাব নাই। রাষ্ট্রবিরােধী ও সমাজ বিরােধী কাণ্ডকারখানার পীঠস্থান হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ। ত্রিপুরাতে উহা আমদানি হওয়া মােটেই অস্বাভাবিক কিছু নহে। পাকিস্তানে ক্যুনিস্ট পার্টি পূর্বাপর বেআইনি ছিল বলিয়া কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন মানুষও তথায় ছিল না মনে করা নিতন্ত ভুল। আমরা জানি দেশ ভাগাভাগির পরও পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) অসংখ্য কম্যুনিস্ট ছিল এবং তাহারা নিষ্ক্রিয় ছিল না। আজ তাহারা শরণার্থী হইয়া ভারতে প্রবেশের পর নিশ্চয়ই চুপ করিয়া ভিজা বিড়ালটির মতাে বসিয়া নাই। বরং দীর্ঘকাল বাধ্য-বাধ্যকতার পর মুক্ত হইয়া অবাধ রাজনৈতিক মাঠে-ময়দানে ঐ সকল খেলােয়াড়গণ (বয়সের দরুন) খেলা খেলিতে না পারিয়া খেইল দেখাইতে কসুর করিবে না। তাহাদের ইজমটারই বিশেষত্ব ইহা। ঘােলা জলে মৎস্য শিকারের নিমিত্ত ক্যুনিস্টরা ত্রিপুরা রাজ্যে স্বাধীনতার শুভ সূচনা হইতে নষ্টামি কম করে নাই। শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে ইন্দিরা বিরােধী প্রচার-প্রচারণা চলিতেছে বলিয়াও সংবাদে প্রকাশ। অতএব অগৌণে ত্রিপুরা সরকারকে সর্বপ্রকার নষ্টামির উৎস সন্ধান ও আবিষ্কারক্রমে উহার প্রতিকার-প্রতিবিধানে সচেষ্ট ও তৎপর হইবার সনির্বন্ধ অনুরােধ পেশ করিতেছি। এই অনুরােধকে ত্রিপুরা সরকার দাবি বলিয়াও গ্রহণ করিতে পারেন। এই দাবি সমগ্র ত্রিপুরাবাসীর; কারণ ত্রিপুরার অতিথি বাৎসলাের উপর কলঙ্কের প্রশ্নে এই দাবি রাখা হইয়াছে।
সূত্র: ত্রিপুরা
৭ জুলাই, ১৯৭১
২২ আষাঢ় ১৩৭৮