You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.23 | সম্পাদকীয়: প্রচারবিমুখতা পরিত্যাগ করুন! | ত্রিপুরা - সংগ্রামের নোটবুক

প্রচারবিমুখতা পরিত্যাগ করুন!

জয় হউক! বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কেন্দ্রীয় পরিষদের জয় হউক! জয় হউক উক্ত সংস্থার (বা প্রতিষ্ঠানের) প্রভু শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের। এই জয় ধ্বনির তাৎপর্য আছে, যেমন তাৎপর্য আছে সঙ্গীতের আসরে করতল ধ্বনির (করতালি বা হাততালির)। সঙ্গীতের মজলিসে যখন কোনাে গান শ্রোতাদের শ্রবণেন্দ্রিয়কে পীড়া দিতে থাকে তখন শ্রোতৃমণ্ডলী করতল ধ্বনি দ্বারা ঐ গায়ককে গানে নিবৃত্ত করে। আমাদের জয়ধ্বনিও কতকটা ঐ করতালির মতােই। এই জয়ধ্বনিকে আপনারা হরিধ্বনি হিসাবেও গ্রহণ করিতে পারেন। নয় সপ্তাহ পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীশচীন্দ্র লাল সিংহের সরকারি বাসভবনে শতাধিক নাগরিক সমাবেশে বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কেন্দ্রীয় পরিষদ নামধেয় সংস্থাটির জন্মবৃত্তান্ত যেমন সময়ােপযােগী তেমনই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ঐ বৈঠকে সংস্থার নামকরণ, উদ্দেশ্য সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহকে উক্ত সংস্থার সভাপতি পদে অভিষিক্ত করিয়া সভাপতির পছন্দসই এগার জন সদস্য লইয়া কার্যকরী কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই ক্ষমতা দানেরও তাৎপর্য আছে। বৈঠকে সমবেত নাগরিকগণের ধারণা শ্রী সিংহ অসাধ্য সাধন করিতে পারেন। তিনি মৃতপ্রায় কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করিয়া রেকর্ড সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহার সাংগঠনিক শক্তির উপর ত্রিপুরার জনসাধারণের (এমনকি বিরুদ্ধ দলগুলােরও) আস্থা ও শ্রদ্ধা অসীম। যদিও অন্তবর্তী লােকসভার সদস্য নির্বাচনে শ্রী সিংহ (অর্থাৎ কংগ্রেস দল) ডাহা ফেল মারিয়াছেন তবু ঐ দিনের বৈঠকে পরিষদের কার্যকরী কমিটি গঠনের ব্যাপারে ব্ল্যাক চেক দেওয়ার প্রস্তাবে কেহই আপত্তি করেন নাই। অর্থাৎ গত এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত শ্রী সিংহের সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পর্কে আগরতলা শহরের নাগরিকগণের মনে কোনাে প্রশ্নই জাগে নাই। বরং মহান গুরু দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার ধীমান ও শক্তিধরের উপর ন্যস্ত করিয়া নাগরিকগণ হাঁপ ছাড়িয়াছিলেন। শ্রী সিংহও গরম গরম সদস্য মনােনীত না করিয়া বিচক্ষণের ন্যায় ডিমে তা দিয়া বাচ্চা ফুটাইবার মতাে পক্ষকাল সময় অতিবাহিত করিয়া এমন একটি কার্যকরী কমিটির নাম প্রকাশ করিলেন যাহাকে পর্বতের মূষিক প্রসবের সহিত তুলনা দেওয়া চলে। অধিকাংশই কংগ্রেস পরিবারভুক্ত (মন্ত্রী, এম. এল. এ. প্রভৃতি) এবং আমলাবর্গ। কয়েকটা সাব কমিটিও করিলেন। কাগজে পত্রে বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কেন্দ্রীয় পরিষদ নমে একটা জাদরেল প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ হইল। লিপিবদ্ধতাই সার। অতঃপর পরিকল্পিত প্রতিষ্ঠানটির কোনাে কাজকর্ম হইয়াছে কি না, বা অচিরেই হইবে কি না সে সম্পর্কে জনসাধারণ ততা দূরের কথা পরিষদের সাধারণ সদস্যগণ পর্যন্ত কিছুই জানে না। তবে সদস্যগণ বিগত দেড় মাসে সদস্য ফি বাবদে দশ টাকা চাঁদা দিবার জন্য বার দুই স্মরণার্থলিপি (তাগিদ পত্র) পাইয়াছেন।
এমন একটা জাদরেল প্রতিষ্ঠান বর্তমান সমস্যা সঙ্কুল পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে নির্বিকার চিত্তে বসিয়া আছে বা থাকিতে পারে তাহা কেহই বিশ্বাস করিবেন না; আমরা জোর দিয়া বলিতে পারি ইহা সৰ্বৰ্থা অবিশ্বাস্য। কথা হইল এই প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় নহে। কাজ না করাটাও তাে ক্রিয়া। অতএব ধরিয়া লইতে পারেন কাজ না করা রূপ’ ক্রিয়াতেই এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যস্ত-ব্ৰিত আছে। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, কার্যকরী কমিটির সদস্যগণের অধিকাংশ হইলেন মন্ত্রী, এম.এল.এ এবং আমলাবর্গ, তাহারা স্ব-স্ব কারিশমায় শরণার্থীদের জন্য নানাভাবে নানা কাজ করিতেছেন। ততােধিক নানা ভাবে কৃত কাজকর্মগুলাের প্রচার বন্ধ করা হইতেছে। কেন যে প্রচার কার্যটা সযত্ন পরিহার করা হইতেছে তাহা দুর্বোধ্য; মনে হয় রহস্যজনকও। আমরা রহস্য উদঘাটনের কথা বলিতেছি না, আমরা দাবি করিতেছি বাংলাদেশ হইতে আগত শরণার্থীদের জন্য ত্রিপুরায় অদ্য পর্যন্ত উক্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে কী কী কাজ করিয়াছে তাহা প্রচারে দেওয়া হােক, যেমন দিতেছে বাংলাদেশ শরণার্থী ত্রাণ মহিলা কমিটি। সরকারি পর্যায়ে ঐ প্রতিষ্ঠানের মহান সদস্যগণ কী করিয়াছেন বা করিবেন- তাহাও প্রচারে দেওয়া উচিত। আজ কয়েকদিন যাবত ত্রিপুরার আকাশে অধিক সংখ্যক বিমানের আনাগােনা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে। নতুন ধরনের বিমান; মনে হয় বিদেশি, কেন আসিতেছে যাইতেছে উহা সরকারি প্রচারের অপেক্ষায় নানা প্রকার সু এবং কু গুজব সৃষ্টির সুযােগ-সুবিধা করিতেছে। শ্রী সিংহ একাধারে মুখ্যমন্ত্রী, পরিষদের সভাপতি এবং প্রচার দপ্তরেরও মন্ত্রী। তিনি জনপ্রিয়তার জন্য খ্যাতি, কীর্তি ও যশ কামাই করিয়াছেন একটি মাত্র কারণে। সেই কারণটি হইল প্রচার। তিনি এককালে সাংবাদিকতায় কিছুকাল কাজ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রচার মাহাত্ম সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। আজ! আজ তিনি প্রচার বিমুখতার হেডমাস্টারি করিতেছেন। কথাটা হইল মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিংহকে মুখপাত্র হিসেবে প্রচারের উচ্চতম পদে বসাইয়া) উপস্থাপিত করিয়া প্রচার যন্ত্রকে বিকল করিয়া রাখা হইয়াছে। কেন বিকল করা হইয়াছে, কে বা কাহারা বিকল করিয়াছে, শ্রী সিংহের তাহা অজানা বিষয় নহে। তৎসঙ্গে শ্ৰী সিংহের ইহাও অজানা বিষয় নহে যে, লােকায়ত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারি প্রচার যন্ত্রকে যথাযথ ব্যবহার না করিলে প্রজাসাধারণের মধ্যে সরকার বিরােধী তথা অপপ্রচারের ক্ষেত্র উর্বর হইয়া ওঠে। প্রচারযন্ত্রকে স্তব্ধ করিয়া জনতার কণ্ঠ রােধ করা স্বৈরতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের কাজ; গণতন্ত্রে উহা আত্মঘাতী হইয়া থাকে। আমাদের বিনীত অনুরােধ মুখমন্ত্রী, প্রচারমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কেন্দ্রীয় পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ প্রচার বিমুখতা পরিহার করিয়া তাহার স্বভাবসুলভ প্রচারমুখর নীতিতে ফিরিয়া আসুন। বিধানসভায় প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি তথ্যবহুল, তথ্যমূলক নহে। বিস্তৃত তথ্য নাই বলিয়াই প্রচার যন্ত্র ব্যবহার না করিয়া বিধানসভায় বিবৃতি দিয়া দায় সারা হইয়াছে।

সূত্র: ত্রিপুরা
২৩ জুন, ১৯৭১