হৃদয় নাই
ত্রিপুরা রাজ্যে নয় লক্ষ শরণার্থী আসিয়াছে। দশ লক্ষ বা এগার বার লক্ষ আসিয়াছে বলিলেও আপত্তি নাই। কারণ শরণার্থী সংবর্ধনার আয়ােজন এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত শিথিল বলিয়া সর্বদার তরে দুই তিন লক্ষ শরণার্থী নাম তালিকাভুক্তি তথা পরিচয় পত্রের জন্য অপেক্ষমান থাকে। পরিচয় পত্র সংগ্রহের জন্য পরিবারের প্রতিটি লােককে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে হাজির থাকিতে হয়। উন্মুক্ত আকাশ তলে বর্ষা বাদল মাথায় করিয়া দিনের পর দিন ধর্না দিয়াও পরিচয়পত্র পাওয়া যায় না। এই বর্ষা বাদলের দিনে সামান্য কয়েকটা ত্রিপলের ব্যবস্থা করিলেই হতভাগ্যদের দুর্ভোগ অনেক কমিতে পারে। তাহা হইবার নহে, কথায় বলে দুর্ভাগ্য একা আসে না; সঙ্গে দুঃখ-দুর্দশাও থাকে। ত্রিপুরা সরকার শরণার্থী সংবর্ধনায় যথােপযুক্ত দুঃখদুর্দশার ব্যবস্থা করিয়াছেন। যে কারণে সপ্তাহ কাল পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিয়া পরিচয়পত্র পাইতে হয়। পরিচয় পত্র দানে শিথিলতার বা কাল হরণের বড় কারণ হইল পরিচয় পত্র দিলেই তাহাদিগকে শিবিরে আশ্রয় ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করিতে হয়। শিবিরের স্থান নাই; শিবিরই নাই। স্কুলগুলাে হইতে অস্থায়ী শিবির ব্যবস্থা উঠাইয়া নেওয়া হইতেছে। আর কতকাল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনা বন্ধ রাখা যায়। নতুন করিয়া প্রয়ােজনানুরূপ শিবির স্থাপন নানা কারণে সম্ভব হইতেছে না। যে কয়টি শিবির করা হইয়াছে বা হইতেছে উহাদের দ্বারা আগত শরণার্থীদের এক চতুর্থাংশের স্থান সংকুলান সম্ভব নহে। অতএব কৌশল করিয়া পরিচয় পত্র প্রদান বিলম্বিত করা হইতেছে। শিবিরগুলােতে আপ্যায়ন ব্যবস্থা অত্যন্ত ক্রটি ও দুর্নীতি পূর্ণ। সমপরিমাণ চাউল, ডাল ও নগদ অর্থে কোনাে কোনাে শিবিরে ডাল, ভাত, তরকারির উপর ডিম দেওয়া হয় এবং ভরপেট খানা সম্পর্কে কোনাে অভিযােগই নাই; কোনাে কোনাে শিবিরে দেখা যায় ডিম তাে দূরের কথা ডাল, ভাত, তরি-তরকারিও ভরপেট খাওয়া জোটে না। সন্তানদের ক্ষুধা মিটাইতে অনেক পিতামাতাকে কোনাে কোনাে শিবিরে প্রায়ই অনশন অর্ধাশনে থাকিতে হয়। এবম্বিধ অভ্যর্থনা আর আপ্যায়নে মানুষ প্রলুব্ধ হইতে পারে না; বরং লজ্জায়, ঘৃণায় ও আত্মধিক্কারে অনেকে এই উভয় কেন্দ্র পরিহার করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সেই চেষ্টার পরিণতি আজ ত্রিপুরার ঘরে ঘরে শরণার্থী। যদিও ত্রিপুরায় আগত শরণার্থীদের একটা উল্লেখযােগ্য সংখ্যা আত্মীয়ের সন্ধানে আসামে ও পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া গিয়াছে তবু কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় শিবিরের বাহিরে অবস্থান করিতেছে। তাহারা প্রায় সােল আনাই আছে আত্মীয়-স্বজনদের ঘাড়ে বােঝাস্বরূপ। এক কথায় ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি পরিবারগুলাে শরণার্থীর চাপে রীতিমতাে বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। এই বিপন্নতা হইতে উদ্ধারের একমাত্র পথ সরকারি শিবিরসমূহে আশ্রয় গ্রহণ। সে পথও প্রায় রুদ্ধ। স্থানাভাব পূরণে ত্রিপুরা সরকার প্রায় ব্যর্থ বা অক্ষম। অর্থাৎ সরকারের দায়দায়িত্ব চাপিয়াছে জন সাধারণের ঘাড়ে। সরকারি শরণার্থী শিবিরে বড় জোর আড়াই লক্ষ শরণার্থী রহিয়াছে। ত্রিপুরা মন্ত্রী পরিষদ এই পরিস্থিতির মােকাবিলা করিবার জন্য গত মাসের মাঝামাঝি শিবির বহির্ভূত (আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রিত) শরণার্থীগণকে শিবিরের হারে ফ্রি রেশন এবং ক্যাশ ডােল দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দুঃখের কথা ঐ সিদ্ধান্ত আজও কার্যকরী হয় নাই। মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত তখনই কার্যকরী হয় যখন উপরাজ্যপাল উহা মঞ্জুর করেন। মঞ্জুরির ক্ষমতা উপরাজ্যপালের আছে। তিনি উহা না করিয়া ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নিকট অনুমােদনের জন্য পাঠাইয়াছেন। এখনও উহা অনুমােদন লাভ করিয়া আসে নাই। কী চমৎকার! মানবতার পিঠে হৃদয়হীনতার কেরামতি। শরণার্থীকে আসিতে দাও! আশ্রয় দেওয়া হইবে। তাহাদের সম্যক দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। শরণার্থী আসিতেছে; আশ্রয় শিবিরে স্থান নাই, আশ্রয় লইতেছে আত্মীয়ের ঘরে। শিবিরের বাহিরে অবস্থানকারী শরণার্থীদের দায়-দায়িত্ব সহায়তার ব্যাপারেই যতাে তালবাহানা। পরিষ্কার দেখা যাইতেছে কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট নীতি থাকা সত্ত্বেও শরণার্থীদের আপ্যায়ণে রাজ্য সরকার বিধিবিধান ও আইনের প্রশ্ন তুলিয়া বিষয়টাকে জটিল এবং বিলম্বিত করিতেছেন। মনে হয় ইচ্ছা করিয়াই উহা করাইতেছে। সরকারের অতিথি; সরকার সেই অতিথিদের স্থান দিতে পারিতেছে না; ইহা সরকারের অক্ষমতা; কিন্তু ক্ষ সত্ত্বেও আহাৰ্য্য দিতে বাড়তি অক্ষমতা আরােপ করিতেছেন রাজ্যের প্রজা সাধারণের ঘাড়ে বােঝা চাপাইয়া। কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট ঘােষণার পর রাজ্য সরকারের এই নীতি বােধ বা নীতিজ্ঞান মানবতার পরিপূরক হয় কী করিয়া তাহা আমাদের দুর্বোধ্য। রাষ্ট্র নীতিতে হৃদয় বলিতে কোনাে জিনিস নাই বা হৃদয়ের স্থান নাই। মানবতার মধ্যেও কি হৃদয় বলিতে কোনাে কিছু নাই? শরণার্থী আপ্যায়ণে হৃদয়ের সন্ধান পাওয়া যায় না কেন? কেন উপরাজ্যপাল মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুমােদনের জন্য সশরীরে দিল্লী যাইয়া দরবার করিলেন না? মুখ্যমন্ত্রীও তাে উপরাজ্যপালের সহিত পরামর্শ করিয়া তাহার সুপারিশসহ দিল্লী যাইয়া উহা করাইতে পারিতেন। বিপন্ন বাঙালিদের জন্য এই দুইয়ের একটি হৃদয়ও সায় দিল না। পণ্ডিত চানক্য বলিয়া গিয়াছে মূখ জগৎ! এরা জানে না যে, চানক্যের হৃদয় নাই। মানুষ যত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও কূটনীতিজ্ঞ হয়, ততােই হৃদয়হীন হয়।
সূত্র: ত্রিপুরা
৯ জুন, ১৯৭১
২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮