You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.28 | সম্পাদকীয়: নিরপেক্ষতা | ত্রিপুরা - সংগ্রামের নোটবুক

নিরপেক্ষতা

বাংলাদেশের মিত্র নাই। সভ্য জগতের একটি রাষ্ট্রও নিপীড়িত, নির্যাতিত এবং অসভ্য বর্বরের নির্মমনির্বিচারে আর্তকণ্ঠ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই। মাসাধিককাল যাবত নবজাতক এই বাংলাদেশ পাক জঙ্গি শাসকের পশ্বাচারের চিত্র-চরিত্র জগৎ সমক্ষে তুলিয়া ধরিয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের নিকট ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ পৌছাইয়াও দিয়াছে। কিন্তু হায়! কেহই সাড়া দিতেছে না। একমাত্র ভারত আর্তের সেবায় আগাইয়া আসিয়াছে, সমবেদনা জানাইতেছে, আন্তরিকতা ও মানবতা দেখাইতেছে। তাহাও সীমিত। মিত্ররূপে বন্ধুত্ব দিবার জন্য ভারতও দ্বিধাগ্রস্ত। ভারতের ভাবনা, বন্ধুত্বের দিকে অগ্রসর হইলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধ পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত হইবে এবং উহা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়াইতে পারে। তাহা না হইলে ভারত নীতিগতভাবে বাংলাদেশের মিত্রতা অতি অবশ্যই গ্রহণ করিত। এমনিতেই পাক সামরিক শাসক সমগ্র জগতকে বুঝাইতে আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছে যে, এই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ ভারতের অবদান, পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও উহার কোনাে অস্তিত্ব নাই, ভারতের অভ্যন্তরেই ঐ কাল্পনিক বাংলাদেশ বিরাজ করিতেছে…ইত্যাদি। যদি ভারত মিত্রতার হস্ত প্রসারিত করিত বা করে পাক। শাসকদের দুরভিসন্ধিই জয়যুক্ত হয়। তখন ভারতীয় হানাদার দমনের নামে পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের শায়েস্তা করিবার জন্য পাক সামরিক শাসক তামাম দুনিয়ার প্রত্যক্ষ সাহায্য পাইতে পারে। ভারত সুকৌশলে পাক শাসকদের সেই সাধে বাধ সাধিয়াছে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে স্বীকার না করিয়া অথচ নৈতিক সমর্থন দিয়া এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দান ও আর্তের সেবায় ঢালাই ব্যবস্থা করিয়া। ভারতের ঐ নৈতিক সমর্থন এবং সেবা পরায়ণতা ও আতিথেয়তা সমগ্র দুনিয়াকে ইচ্ছায় হােক, অনিচ্ছায় হােক বিচলিত ও বিগলিত ভাব প্রকাশে বাধ্য করিয়াছে। কয়েকটি রাষ্ট্র ভারতের এই সেবামূলক মানবতার তারিফও করিতেছে। এমনকি পাকিস্তানের আজন্মের স্থায়ী অভিভাবক আমেরিকা পর্যন্ত (ভয়েস অব আমেরিকা) আজ বলিতে বাধ্য হইয়াছে যে, ইহাতে ভারতের কোনাে হাত নাই, পাক জঙ্গি শাসকই প্রথমে বাঙালিদের উপর চড়াও হইয়াছে। সেখানে ব্যাপকভাবে নরহত্যাদি চলিতেছে। বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা হইল পরবর্তী ঘটনা। দুই পাকিস্তানের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলিতেছে উহাতে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল হইতে দুর্বলতর হইয়া ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে। পাকিস্তানের নয়া দোস্ত রাশিয়া, যাহাদের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশকে প্রেত নগরীতে পরিণত করিবার জন্য ব্যবহৃত হইতেছে, তাহারাও এই নরমেধ যজ্ঞের নিন্দা করিয়াছে এবং দুই দফায় এই সংঘর্ষ বন্ধ করিবার নিমিত্ত জঙ্গি শাসকের নিকট অনুরােধ পত্র প্রেরণ করিয়াছে। গ্রেট ব্রিটেন আরও একধাপ আগাইয়া সরেজমিনে প্রকৃত অবস্থা তদন্ত পর্যবেক্ষণ করিয়া দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভারতের সহ্য ধৈর্যের প্রশংসা করিয়াছেন। তাহাদের মন্তব্য হইল অনতিবিলম্বে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমধান হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ বিবাদমান পক্ষদ্বয় কোনাে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় ঘরােয়া ব্যাপারটা মিটাইয়া ফেলুক। এককথায় বলা যাইতে পারে সভ্যতা ও ভদ্রতার মুখােস পরিহিত বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহ মুখােসের খাতিরে (মুখ রাখার জন্য) পাক দস্যুবৃত্তির নিন্দা না করিলেই নয় বলিয়া মুখ খুলিতেছে। বস্তুত দানবের পৃথিবী, মানবের তরে নয়। তবু ভালাে একমাত্র চীন ছাড়া অন্য কোনাে রাষ্ট্র খােলাখুলিভাবে পাক জঙ্গি শাসনকে মদদ যােগাইবার হুঙ্কার ছাড়ে নাই। আরও একটা জিনিস লক্ষ করা যায়, এখন পর্যন্ত দানব জগতের কোনাে রাষ্ট্র পাক জঙ্গি শাসকের কথায় সায় দিয়া ভারতকে দায়ী করে নাই। তবে এ কথা ঠিক ভারতকে এই সংঘর্ষের মধ্যে লিপ্ত করিবার জন্য চেষ্টার অবধি রাখা হইতেছে না। এই জন্য পাক ফৌজ ভারত সীমান্ত অতিক্রম করিয়া তিনজন সীমান্ত প্রহরীকে চুরি করিয়া নিয়াছে এবং কয়েক জায়গায় ভারতের অভ্যন্তরে গােলাগুলি নিক্ষেপ করিয়া একজন ভারতীয়কে খুন এবং কয়েকজনকে আহত করিয়াছে। পদে পদে প্ররােচণা দ্বারা ভারতকে সংঘর্ষে নামাইবার জন্য আন্তর্জাতিক সীমান্তবিধি লঙ্ন করিয়া সৈন্য ছাওনি বসাইতেছে এবং কামান পাতিয়াছে। জঙ্গি বিমানে আকাশ সীমা অতিক্ৰমতাে হামেসাই করিতেছে। ভারত পাক জঙ্গি শাসকের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া এখনাে প্ররােচনার ফাঁদে পা দেয় নাই। সহ্যেরও সীমা আছে, ধৈর্যেরও বাঁধ থাকে; কূটনৈতিক মিশন লইয়া পাকিস্তান যে খেলা শুরু করিয়াছে তাহাতে সহ্য ধৈর্য যদি ভাঙিয়া পড়ে তখনই দেখা যাইবে বর্তমান সভ্য জগতে মানবতার দাম কতটুকু, স্থানই বা কোথায়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্পাদক এ সম্পর্কে মৌনীবাবার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাকে সবিনয়ে প্রশ্ন করা যাইতে পারে, মানব অধিকার বিষয়টি পূর্ব বাংলায় প্রয়ােগ করা হইতেছে না কেন? দানব গােষ্ঠীর অনুমােদন না পাওয়া পর্যন্ত তিনি মৌব্রত ভাঙিতে পারেন না। হইতে পারেন তিনি মহামানব; কিন্তু দানবের আজ্ঞাবাহী। রাষ্ট্রপুঞ্জের কীর্তিকাণ্ড সমালােচনা করিতে গেলে মহাভারত রচনা করিয়াও শেষ করা যাইবে না। অতএব এইটুকুতেই ইতি। আসল কথা হইল ‘বাংলাদেশ’, এই বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন জানাইয়া ভারত বিশ্বরাষ্ট্রসমূহের মতিগতি প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হইবার সুবর্ণ সুযােগ করিয়া লইয়াছে। ভারত আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে পারিতেছে যে, প্রকৃত বন্ধু বলিতে কেহ নাই; প্রকাশ্য শত্রুতা করিবার হিম্মতও তাদের নাই একমাত্র চীন ও পাকিস্তান ব্যতীত। ভারতের সমৃদ্ধি ও উন্নতি প্রায় সকলেরই ঈর্ষার বস্তু। ইহার কারণ জোট নিরপেক্ষমতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। নবগঠিত বাংলাদেশের মতিগতি নীতি এযাবৎ যতটুকু উদঘাটিত হইয়াছে তাহা ভারতের অনুরূপ। অতএব জোটবদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বাধীনতার দ্বারা কেহই লাভবান হইবে বলিয়া আশা-ভরসা করিতে পারিতেছে না, অধিকন্তু এই ধারণাই আজ তাহাদিগকে আশঙ্কিত করিতেছে যে, ভাবী বিশ্বে জোট ও ধর্মনিরপেক্ষতা অধিকতর শক্তিশালী হইবে।

সূত্র: ত্রিপুরা
২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
১৪ বৈশাখ, ১৩৭৮