মুক্তিকামের মুক্তিব্ৰত ভাঙ্গতে কারাে সাধ্য নাই
বাংলাদেশে’ ধ্বংসের তাণ্ডব চলিতেছে। খবরের কাগজগুলাে সেই ধ্বংসলীলার কতটুকুই বা প্রকাশ করিতে পারিতেছে। অপ্রকাশিত কাহিনী অনেক, অনেক সংবাদ চাপা পড়িয়াছে শব্যুপে। শিয়াল, কুকুর, শকুনী প্রভৃতির সাধ্য কি যে শব খাইয়া শেষ করে। ইহাদের আহারে আর ইচ্ছা নাই। কচুরীপানা যেমন জলপথ অবরােধ করে ঠিক তেমনই অবরােধ সৃষ্টি হইয়াছে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বড় বড় শহরের পথ-প্রান্তর, নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মৃতদেহ দ্বারা। জনবহুল জনপদগুলােতে জীবন্ত মানুষের দেখা-সাক্ষাৎ লাভ ঈশ্বরদর্শন লাভের মতাে দৈব দুর্ঘট ব্যাপার। রাস্তায় চলা যায় না। পদক্ষেপ করিতে গেলেই গলিত শবদেহ মাড়াইয়া আগাইতে হয়। দাঁড়াইয়া থাকাও অসম্ভব। পচা হাড় মাংসের দুর্গন্ধে নিশ্বাসেরও উপায় নাই। বস্তিগুলাের কথা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না; কারণ বড় বড় প্রাসাদোপম ইমারতগুলাে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইয়াছে। বাজার, গঞ্জ, হাট প্রভৃতির চিহ্ন মাত্রও আজ আর অবশিষ্ট নাই। সপ্তাহ কাল আগেও যাহা ছিল বাস্তব সত্য আজ তাহা মিথ্যায় পর্যবসিত হইয়াছে। যেদিকে দৃষ্টি যায় সেই দিকেই ধ্বংসের মূর্তি। পাক জঙ্গি শাসক সােনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করিতেছে। ঢাকা হইতে সদ্য আগত জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট হইতে প্রাপ্ত বিবরণীর সার কথা হইল এক ঢাকা অঞ্চলেই কমপক্ষে চারি লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে। নিহতদের শতকরা আশি ভাগই নারী ও শিশু। সমান তালে নরমেধ যজ্ঞ চলিয়াছে চট্টগ্রাম, খুলনা, যশােহর ও রংপুরে। সমগ্র বিশ্ব এই পৈশাচিক নরমেধ যজ্ঞ ও জনপদ বিধ্বংসের তাণ্ডবলীলা হতচকিত নেত্রে নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকায় দেখিতেছে, শুনিতেছে। যে নৃশংসতার তুলনা ইতিহাস খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, যে বর্বরতা নাৎসী বর্বরতার ইতিহাসকে স্নান করিয়া দিয়াছে, যে নরহত্যার বীভৎসতা প্রলয়কেও হার মানাইয়াছে- সেইসব নারকীয় ও পৈশাচিক কাণ্ডকারখানা বর্তমান প্রগতিশীল সুসভ্য রাষ্ট্রনায়কগণ পাকিস্ত নের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া প্রকারান্তরে পাকজঙ্গি শাসকের জল্লাদি নীতির সমর্থন করিতেছে। শুধু সমর্থনই নহে, কোনাে কোনাে রাষ্ট্র, যেমন চীন, সিংহল ও ব্রহ্মদেশ রীতিমতাে সহায়তা করিতেছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রপুঞ্জও এই ব্যাপারে পরম পুরুষের ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করিতেছে। ভারত ছাড়া পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্র ইহার নিন্দা-প্রতিবাদ করে নাই এবং নরহত্যা বন্ধের জন্য আওয়াজ তুলে নাই। ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিকট নালিশ দায়ের করিয়া অনতিবিলম্বে এই নরমেধ যজ্ঞের অবসান ঘটাইবার জন্য আবেদন পেশ করিয়াছে। সাম্যবাদের পীঠস্থান তথাকথিত প্রগতিশীল সুসভ্য রাশিয়া অতিকষ্টে এই রক্তস্রোত বন্ধ করিবার জন্য জহলাদ-সম্রাট ইয়াহিয়া খাকে অনুরােধ পত্র দিয়াছেন। যাহার অর্থ হইল, কিছু না বলা বরং ভালাে এই রকম বলার চাইতে। পরিষ্কার বােঝা যায় সকল রাষ্ট্রই মূলত এক নীতির উপাসক। সেই নীতিটি হইল কবির কথায় বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে, একা আমি বসে রব উদ্দেশ্য সাধিতে।’ কবির সেই উদ্দেশ্য বর্তমান জগত বিপরীত ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে। কে নিন্দা করিবে? মানবতা কোথায়? পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্র মানবতার কুঁটি চাপিয়া ধরে নাই? আজ সকলেই কম-বেশি দোষী এবং দাগি আসামির পর্যায়ভুক্ত। মানবতা ধ্বংসের রক্তে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের হাতই রক্তাক্ত। অতএব মানবতার দোহাই দিয়া এ হত্যালীলার অবসান ঘটাইবার সৎ সাহস দেখাইবে কে? কথা বলিতে গেলেই কথা শুনিতে হইবে এবং অতি যত্নে চাপা দেওয়া কুকীর্তিগুলাে লইয়া রাষ্ট্রসংঘে যাবরকাটা চলিবে ভয়ে কেহই মুখ খুলিতে চায় না। তবু মুখ খুলিতে যদি স্বার্থের সম্পর্ক স্থাপনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকিত। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে এখনও বাংলাদেশ’কে আপন স্বার্থে ব্যবহার করিবার মতাে স্বার্থের সন্ধান করিতে পারে নাই। অতএব নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ এবং তলে তলে স্বকীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধির মতলবে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্বার্থের সন্ধান ছিল (এখনও বােধ হয় আছে) বলিয়াই তাে সিংহল এবং ব্রহ্মদেশ জল্লাদি ফৌজ পরিবহনে প্রত্যক্ষ-পরােক্ষ সহায়তা করিতেছে। অবশ্য উভয় রাষ্ট্র এখন বিরত হইয়াছে বলিয়া ঘােষণা দিয়াছে। এই ঘােষণা যাচাইয়ের অপেক্ষা রাখে।
ভারত এই ব্যাপারে অগ্রসর হইল কেন? শুধু মানবতার জন্য? না অন্য কোনাে কারণে? দুটোই। সৃজনাবধি ভারত মানবতার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করিয়া আসিতেছে। ঔপনিবেশিকতাকে ভারত কোনােদিন সমর্থন করে না। বড় কথা হইল ভারত গণতন্ত্রকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করিয়াছে। গণতন্ত্রের শক্রকে ভারত কোনাে মতেই বরদাস্ত করিতে পারে না। পাশের বাড়িতে আগুন লাগিলে প্রতিবেশীরা নীরব নিষ্ক্রিয় থাকিতে পারে কি? পারে না; না পারাটাই স্বাভাবিক। ভারত স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন এবং বিচলিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে বদ উদ্দেশ্য আরােপ করার কোনাে যুক্তিসঙ্গত হেতু নাই। পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রের অভ্যুত্থান সম্পর্কে আশার আলাে দেখা দিয়াছিল। সেই গণতন্ত্রকে আঁতুর ঘরে গলা টিপিয়া মারিতে সচেষ্ট জঙ্গি শাসকের কার্যকলাপ ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় প্রতিটি মানুষকে আতঙ্কিত করিয়াছে। সেই আতঙ্কেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়াছে ভারতের প্রতিটি রাজ্য বিধানসভায় মুজিবরের গণতান্ত্রিক সরকারকে তথা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব গ্রহণের দ্বারা। ভারত সরকার এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক নীতি শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করিতেছে। আমাদের মতে আত্মরক্ষার্থে ‘আমনং সততং রক্ষেৎ’ ন্যায়-নীতি বাক্যানুসারে ভারতের অনতিবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়া গণতন্ত্রের আপদবালাই দূর করা উচিত। আরও একটা কারণে, পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী তথাকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা বিধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারতের হস্তক্ষেপ নীতি বিগর্হিত কাজ নহে।
আজ প্রায় দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত হইতে চলিয়াছে পাক জঙ্গি ফৌজ তাহার সর্বশক্তি নিয়ােগ করিয়া লক্ষ লক্ষ লােকের প্রাণনাশসহ সম্পদ-সম্পত্তি ও জনপদ ধ্বংস করিয়া যাইতেছে। অন্যদিকে সমান তালে মুক্তিফৌজ বাহিনী জান কবুল লড়াইয়ে জঙ্গি ফৌজকে সৈন্য বিবরে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য করিয়াছে। জঙ্গি ফৌজ সম্মুখ সময়ে পর্যুদস্ত হইয়া এখন বিমান হইতে চোরা গুপ্ত আক্রমণকেই একমাত্র সম্বল করিয়াছে। পরিষ্কার বােঝা যাইতেছে মুক্তিকামের মুক্তিব্ৰত ভাঙিবার যত সাধই জঙ্গি ফৌজের থাকুক না কেন, সাধ্য নাই, কোনাে সাধ্য নাই।
সূত্র: ত্রিপুরা
৭ এপ্রিল, ১৯৭১
২৫ চৈত্র, ১৩৭৭