পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম জিন্দাবাদ
করাচির ফ্যাসিস্ট মিলিটারি ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খার অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার দেশভক্ত মুক্তিযযাদ্ধাদের অপরাজেয় গণঅভ্যুত্থানকে জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন!
কপট আপােস আলােচনার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদের ঐ পােষা কুকুরটি ষড়যন্ত্র করেছিল পূর্ব বাংলার জনগণের স্বশাসনের দাবিকে রক্তগঙ্গায় ডুবিয়ে দেবার। তাই যে আওয়ামী লীগ জনগণের শতকরা ৯৫টি ভােট পেয়েছে তাকে নিষিদ্ধ করে তার নেতাকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘােষণা করে। ‘জঙ্গি আইনের রক্তাক্ত শাসন চালু করে সামন্ততন্ত্র ও বুর্জোয়া শােষণের ঐ ঘৃণ্য পাহারাদার বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মুখােশ ছিড়ে ফেলে, নেংটা হয়ে ময়দানে নেমেছে ট্যাংক, মেশিনগান, বেয়নেট হাতে নিয়ে। সীমান্ত ছেড়ে দিয়ে ফ্যাসিস্ট বাহিনী দেশের অগণিত ছাত্র-যুবক হত করছে নির্বিচারে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার পথে পথে; বিদ্রোহী’ পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীও রেহাই পাচ্ছে না এই জল্লাদদের আক্রমণ থেকে।
পূর্ব বাংলার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ এই ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে। গ্রাম ও শহরে স্বতঃস্ফুর্ত গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়ে ফ্যাসিস্ট হত্যাকারীর দল দিশেহারা হয়ে পড়ছে। এই দখলদার দস্যুদলকে দেশভক্ত মুক্তিযােদ্ধারা সর্বত্র আঘাত করছেন, হাতের কাছে যে অস্ত্র পাচ্ছেন তাই নিয়ে। পূর্ব বাংলার অধিকাংশ এলাকায় ক্রমশ মুক্ত হচ্ছে দস্যু বাহিনীর কবল থেকে। কিন্তু শত্রু নির্মম এবং তার পেছনে আছে বিশ্ব জোড়া সাম্রাজ্যবাদ ধনিক জমিদারদের সমর্থন। কাজেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়ােজন বিশ্ব জনগণের। ভারতের প্রতি প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ জনগণের কণ্ঠে দাবি উঠছে পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বপ্রকার সাহায্য দাও, অস্ত্র, দাও, অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দাও। কিন্তু ভারত সরকারের প্রতিনিধি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভা পর্যন্ত দাবি করেননি গণহত্যার প্রতিবাদে তাদের সমর্থন এখনাে তেমন উল্লেখযােগ্য নয়।
ইহা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে কোনাে গণঅভ্যুত্থানই শাসকগােষ্ঠীর বুকে সৃষ্টি করে ভয়। তারা জানে আজ পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও তার আগুন ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। কাজেই মৌখিক সহানুভূতি জানিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার সংগ্রামী জনগণকে অভিনন্দন জানাই। তারা প্রতিবেশী মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য সর্বত্র উন্মাদ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই উন্মাদনাকে আরাে সংগঠিত ও সার্থক রূপ দিতে হবে। কারণ পূর্ব বাংলার এই মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। এই সংগ্রাম যতই দীর্ঘস্থায়ী হবে, যতই গ্রামের কোটি কোটি কৃষক এই সংগ্রামে ‘আরাে সক্রিয় ভূমিকা নিবেন, যতই সংগ্রামে কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচী আরাে স্পষ্ট হয়ে সামনে আসবে ততই শত্রু পূর্ব বাংলা ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে। পূর্ব বাংলা তাই বিপ্লবী ঘাঁটিতে পরিণত হবে। ত্রিপুরার সংগ্রামী জনতা একদিকে জনমত গঠন করছেন, ইন্দিরা সরকারকে তার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে বাধ্য করার জন্য। মুক্ত এলাকার অর্থনীতি যাতে বিপন্ন না হয় তার দিকে নজর রাখতে বাধ্য করার জন্য, অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করার জন্য। অপরদিকে, তাদের লক্ষ রাখতে হবে, দেশদ্রোহী চোরা কারবারীরা যাতে এই মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার না করে তাদের মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে, যাতে মুক্তিযােদ্ধাদের আমরা অবিলম্বে পাঠাতে পারি, ওষুধপত্র, অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য। যাতে শহীদদের পরিবারকে আমরা রক্ষা করতে পারি, আমাদের সংগ্রামী বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। আমাদের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতার অগ্নিপরীক্ষা হবে এই সকল পবিত্র দায়িত্ব পালনে।
সূত্র: দেশের ডাক
০২ এপ্রিল, ১৯৭১