You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.12 | সম্পাদকীয়: পূর্ব বাংলার সংগ্রামকে জানাই অভিনন্দন! | দেশের ডাক - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব বাংলার সংগ্রামকে জানাই অভিনন্দন!

পূর্ব বাংলার ভাই-বােনেরা রক্ত দিচ্ছেন। রক্ত দিচ্ছেন ছাত্র-যুবক হাজারে হাজারে, গ্রামে ও শহরে মরণপণ সংগ্রামে।
অথচ দু’দিন আগে সেখানে নির্বাচন হলাে। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের কী কপট খেলা দেখলাে সকলে। স্বাধীন নির্বাচন। প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের কী গুণগান! যারা সহজেই বুর্জোয়াদের কথায় ভুলে যান তারা ভাবলেন, শেখ মুজিবুরের দল আওয়ামী লীগ শতকরা ৯০টি ভােট পেয়েছেন, পাক সরকার নিশ্চয়ই জনগণের রায় মেনে নিয়ে শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রীর গতিতে বসাবেন- পূর্ব বাংলার ৬ দফা দাবি মেনে নেবেন।
মুহূর্তের মধ্যে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের মুখােশ খুলে গেল। প্রতিক্রিয়া পূর্ব বাংলায় এখন আর শাসন করছে না; কমরেড লেনিনের ভাষায় নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
শেখ মুজিব বলছেন, পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। মুক্তি কার হাত থেকে? কে পূর্ব বাংলাকে স্বায়ত্বশাসনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, স্বায়ত্বশাসনের বদলে বন্দুকের শাসন কায়েম করেছে? মুক্তি অত্যাচারী কেন্দ্রীয় শাসনের হাত থেকে। করাচিতে যে প্রতিক্রিয়া শক্তি শক্ত হাতে রাজত্ব চালাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তার বিরুদ্ধে।
যারা এর মধ্যে শুধু বাঙালির মুক্তি খুঁজছেন, তাদের বুঝতে হবে- সংগ্রাম অবাঙালির বিরুদ্ধে নয়। সংগ্রাম জমিদার পুঁজিপতি পরিচালিত কেন্দ্রীয় পাক সরকারের বিরুদ্ধে যেখানে বর্তমানে অবাঙালি প্রাধান্য রয়েছে। এই জাতীয় সংগ্রামের পটভূমিতে দেখতে হবে, পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ধনতান্ত্রিক সঙ্কট, সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শােধনের কদর্ষ চেহারা, ধনতান্ত্রিক পথে এ সঙ্কটের সমাধানে পাক শাসকগােষ্ঠীর চরম ব্যর্থতা। পূর্ব বাংলার কৃষক দেখেছেন, সরকার বদল হয়েছে বারবার, কখনাে ভােটে, কখনাে মিলিটারির হুকুমে। কিন্তু জমিদার-মহাজনের শােষণ বৃটিশ রাজত্ব থেকেও বেড়েছে। বেড়েছে খাজনা-ট্যাক্স। যুবক দেখেছেন- ধনতন্ত্রের কদর্য চেহারা বেকার সমস্যার মধ্যে। ছাত্রসমাজ দেখেছেন- ভাষার উপর আক্রমণ ও শিক্ষা সংস্কারের মধ্যে। ব্যবসায়ী দেখেছেন কীভাবে তাদের ছােট ব্যবসাগুলাে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- জনতার ক্রয় ক্ষমতার অভাবে। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি সােচ্চার হয়েছে পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণীর জনতার মধ্য থেকে এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বাঁচার তাগিদে। শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির মধ্যে ঐ দাবি প্রতিফলিত হয়েছে।
তাই পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষ আজ কারাে বাধা মানতে রাজি নন। জঙ্গি আইন লক্ষ মানুষের পায়ের তলায়, মিলিটারির গুলি ব্যর্থ। কেন্দ্রীয় পাক সরকারের সকল আইন ও আদেশ অচল। সর্বোচ্চ আদালত মিলিটারি গভর্নরকে শপথ বাক্য পড়াতে অনিচ্ছুক। ব্যাংক কেন্দ্রীয় পাক সরকারের সাথে টাকা লেনদেন করেন না। ডাক্তার তাদের সাথে যােগাযােগ রাখে না। বিমানকে তারা তেল নিতে দেন না। কেন্দ্রীয় পাক সরকারকে তারা খাজনা ও ট্যাক্স দেন না। সকল সম্পর্কচ্ছেদ করে তারা শুরু করেছেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ‘অসহযােগ আন্দোলন। ১৯৪২-এ গান্ধীজী বৃটিশের বিরুদ্ধে যেমন শুরু করেছিলেন, ‘করেঙ্গে ঔর মরেঙ্গে আন্দোলন, শেখ মুজিব পূর্ব বাংলায় তারই ডাক দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করতে তার সাথে আপােস করতে তাদের বাধ্য করতে।
পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় পাক সরকার আজ যে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে, পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ না হয়ে পারেন না। এই সংগ্রামী মানুষের প্রতি তাদের সমর্থন স্বতঃস্ফুর্ত এবং সর্ব ব্যাপক।
পশ্চিম বাংলার সংগ্রামী মানুষের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কাজ শুরু করেছে দিল্লীর কংগ্রেসী শাসকগােষ্ঠী। সেখানেও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করে, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ গভর্নরের শাসন কায়েম করে ১১ মাস সি.আর.পি রাজত্ব চালিয়েছেন। শত শত ছাত্র-যুবকের রক্ত ঝরেছে কারখানা, স্কুল-কলেজে ও গ্রাম-বন্দরে। সেখানেও কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠী বঞ্চিত করেছে পশ্চিম বাংলার সংগ্রামী মানুষকে তাদের ন্যায় দাবি থেকে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে। সেখানেও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্যক বােঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে- পশ্চিম বাংলার বেকার ও ক্ষুধার্ত জনগণের কাধে। পশ্চিম বাংলার মেহনতি মানুষ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছেন মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ সংকল্প নিয়েছেন কেন্দ্রীয় অত্যাচারী শাসন থেকে পশ্চিম বাংলাকে রক্ষা করার সংগ্রামে জীবন দানের। নির্বাচন তাই তীব্র শ্রেণী-সংগ্রামের রূপ নিচ্ছে।
পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় বাংলার মানুষ চেয়েছিলেন, ভােটের বাক্সে, শান্তিপূর্ণ পথে তাদের ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবি আদায় করতে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠী তাদের সে দাবিকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে, বুলেট ও বেয়নেটে। তাই তাদের আজ গড়ে তুলতে হচ্ছে গ্রাম ও শহরে প্রতিরােধের দুর্গ, প্রতিরােধ প্রতিক্রিয়ার হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে, কেন্দ্রের শক্ত হাতের শাসনের বিরুদ্ধে। ত্রিপুরার অবহেলিত মানুষ আজ অভিনন্দন জানাচ্ছে- এই উভয় বাংলার প্রতিরােধ সংগ্রামকে, আত্মরক্ষা ও আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে। আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এই দুর্জয় প্রতিরােধ থেকে, তৈরি হতে হবে প্রতিক্রিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে।

সূত্র: দেশের ডাক
১২ মার্চ, ১৯৭১