স্বাধীন বাংলাকে বিপ্লবী অভিনন্দন
মার্কিন সাহায্যপুষ্ট দস্যু ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, রাজধানী ঢাকা শহরে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উড়ছে। পৃথিবীর বুকে জন্মলাভ করেছে একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা এই নতুন শিশুকে জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন। বাংলাদেশে এবং ভারতের যে সকল দেশভক্ত মুক্তিযােদ্ধা, ভারতীয় বাহিনীর নওজোয়ান এবং বেসামরিক নাগরিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমরা তাদের স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি বিপ্লবী শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই দিনটিকে পিছিয়ে দেবার জন্য কম ষড়যন্ত্র করে নাই। আমাদের দেশে যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর এতদিন আস্থা স্থাপন করে এসেছেন, তারাও রাজনৈতিক সমাধানে’র মরীচিকার পেছনে ছুটে অনেক কালক্ষেপ করেছেন। আজ তাদের অনেকের মােহমুক্তি ঘটেছে। জাতিসংঘের ভােটাভুটি থেকে তারা স্পষ্টই উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশের প্রশ্নে সােভিয়েত দেশ এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আরাে কয়েকটা দেশ ছাড়া আর কেউ ভারতের পেছনে নেই। ধনতান্ত্রিক শিবিরের কোনাে দেশই বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতের সমর্থনে ভােট দেন নাই।
জাতিসংঘে পাক প্রতিনিধি আপসােস করে বলেছেন, শেখ মুজিবর রহমানও স্বাধীন বাংলা দাবি করেন নাই, যা ভারত সরকার এখন দাবি করছেন। পাক প্রতিনিধি ভুলে গিয়েছিলেন যে, শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির জবাব কারা দিয়েছেন, তাকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘােষণা করে, দশ লক্ষ নরনারীকে হত্যা করে, এককোটি বাঙালির বাড়িঘরে আগুন দিয়ে, তাদের শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়েছে। পাক দস্যু সরকারই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীকে বাধ্য করেছেন, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে।
ইহা দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, গণচীনের সরকার সমাজতান্ত্রিক শিবিরে থেকেও বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন; বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে না দেখে শুধু সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের দুরভিসন্ধি খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়েছেন।
সত্যি সত্যি যদি বাংলাদেশের কোটি কোটি নর-নারীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র না হতাে তবে কি এতাে সহজে ভারতীয় সৈন্যের সঙ্গে ঢাকা পৌছা সম্ভব হতাে? গত ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ভারত বিরােধী বিদ্বেষ প্রচার করেছে বাংলার ঘরে ঘরে, কখনাে কাশ্মীর, কখনাে খালের জলের সমস্যাকে কেন্দ্র করে। আজও দস্যু ইয়াহিয়া ধর্মের জিগির তুলছে, সারা মুসলিম দুনিয়ার নাম করে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনাে মানুষের মনে কি এসকল প্রচার কোনাে দাগ কেটেছে, কোনাে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পেরেছে? বরং দেখা গেছে, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ যুবক, যারা অস্ত্র হাতে মুক্তিফৌজে যােগ দিয়েছেন এবং গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছেন ভারতীয় ফৌজ বাংলার মাটিতে পা ফেলবার অনেক আগে। তারা জনতার মধ্যে সৃষ্টি করতে পেরেছেন অপূর্ব উৎস, শত্রুর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। মিত্রশক্তি হিসেবে ভারতের প্রাপ্ত সকৃতজ্ঞ অনুভূতি। গণচীনের নেতারা সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে যদি বাংলাদেশর মুক্তিকামী মানুষের এই নতুন শক্তিকে না দেখতে পান, তবে তার চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন আমাদের জয়ের আনন্দে দিশেহারা না করে। কারণ, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের প্রধান পাণ্ডা মার্কিন দস্যুরা অর্থ সঙ্কটে যতােই জর্জরিত হােক না কেন, এখনাে সপ্তম নৌবহর নিয়ে চট্টগ্রামের আশপাশে ঘুরছে। তাদের হাতে আছে জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাব। তাদের ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আছে আরাে অনেক দেশ। ঢাকা শহরের ক্ষত তাদের দুর্বল করতে পারে, কিন্তু এখনাে হতাশ করে নাই। কারণ, গত ২৩ বছর তারা শুধু পাকিস্তানের নয়, ভারতে, এমনকি বাংলাদেশেও কম দালাল সৃষ্টি করে নাই। তাই, আমরা দাবি করবাে, ভারত সরকার মার্কিন ঋণ পরিশােধ বন্ধ রেখে, মার্কিন তৈল কোম্পানি বাজেয়াপ্ত করে, মার্কিন সংস্থাসমূহ বেআইনি ঘােষণা করে, তাদের মার্কিন ঘেঁষা নীতিকে কবর দিন। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাথে বন্ধুত্ব আরাে দৃঢ় করার জন্য অবিলম্বে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার এবং জার্মান প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি দিন। বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে সেখানকার জনগণকে সর্বতােভাবে সাহায্য করুন। বাংলাদেশের ভবিষ্যত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী মানুষকে গড়ে তুলবার সুযােগ দিন।
বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন। তারা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বুকে চরম আঘাত হেনেছে; এই উপমহাদেশের প্রতিক্রিয়ার দুর্গকে চুরমার করে দিয়েছেন; তারা সাড়ে সাত কোটি মেহনতি জনতার জন্যই শুধু প্রগতির পথ উন্মুক্ত করেন নাই, আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে প্রেরণা দিয়েছেন সংগ্রামের পথে অগ্রসর হতে। তাদের এ জয়যাত্রা প্রতিদিন আরাে নতুন নতুন সাফল্যের পথ উন্মুক্ত করবে- এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
সূত্র: দেশের ডাক
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭
৮ পৌষ, ১৩৭৮