জয় করাে না, মুক্ত কর!
পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক অরােরা ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে লক্ষ করে বলেছেন, বাংলাদেশে তােমরা গিয়েছ, সে দেশকে মুক্ত করতে, জয় করতে নয়!
ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি দেবার পক্ষে, তার সৈন্য বাহিনীর যে ভূমিকা থাকা দরকার অরােরার এ মন্তব্যে তা যথাযথ ব্যক্ত হয়েছে। হিটলার-মুসােলিনী তােজোর ফ্যাসিস্ট বাহিনীর কাল থেকে এক দিনের পৃথিবীর বহু ফ্যাসি-বিরােধী দেশের সৈন্যদলের উপর যে দায়িত্ব বর্তেছিল, ইতিহাস ভারতীয় সৈন্য দলের উপর সে দায়িত্বই অর্পণ করেছে। সে দিনের মতাে আজও ভারত সরকারকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সহায় ভূমিকা গ্রহণ করে বাংলাদেশের জনমনের ভাগ্য সে দেশের সংগ্রামী সাড়ে সাত কোটি জনতার ভাগ্যে অর্পণ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলাে যেমন মুক্ত হচ্ছে, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেমন গ্রাম ও শহর মুক্ত হবে বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তেমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে মুক্ত লােকের গণপ্রজাতন্ত্রিক সরকারের প্রশাসনযন্ত্রকে শক্তিশালী করার, যুদ্ধে ক্ষতি অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করার জনগণের সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের গণকমিটি গঠন করে সম্রান্ত এলাকার আইন-শৃঙ্খলা দৃঢ় করার, শক্রর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনগণের রাজনীতিক প্রচার ব্যাপক করে সংগ্রামী ঐক্যকে দৃঢ় করার। যে এক কোটি শরণার্থী আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের ফিরে যাবার পথ প্রশস্ত করতে হবে, তাদের ঘরবাড়ি-জমি ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করার সাথে সাথে স্থানীয় জনতার সাথে তাদের সম্পর্কের যাতে কোনাে অবনতি না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
এখন থাক: যে দান যাতে সমাজ বিরােধীদের হাতে না পড়ে তার দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশে এখন নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্যের সঙ্কট আরাে তীব্র হবে; উৎপাদন চালু রাখার জন্য কাঁচামাল আমদানি করা বিরাট সমস্যা হবে। ভারত সরকারকেই অর্থনৈতিক মুক্তি করতে হবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে এই সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনতাকে সাহায্য করার জন্য।
সর্বোপরি, বাংলাদেশে যাতে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা কীভাবে আমাদের এ দায়িত্ব পালন করবাে তার উপরে নির্ভর করবে, বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক কতখানি দৃঢ় হবে, কতখানি ভ্রাতৃত্বমূলক হবে। এই ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কই আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তি দেবে প্রতিক্রিয়ার সকল অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করতে।
বাংলাদেশের মুক্তি পাক দস্যুদের বুকে চরম আঘাত হানলেও এ কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, ভারতের উপর আক্রমণের তীব্রতা তাতে কমবে না। কারণ, জাতিসংঘের সাম্প্রতিক আলােচনায় দেখা গেছে, পাক দস্যুদের সমর্থনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জোটবদ্ধ হয়েছে। তারা বাংলাদেশের উপর দস্যু ইয়াহিয়ার প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সকল প্রকার সম্ভাব্য পন্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হবে। তাই দেশরক্ষা ব্যবস্থাকে আরাে দৃঢ় করা, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে আরে সম্প্রসারিত করা, কায়েমী স্বার্থের শােষণ জুলুমকে সংযত করার জন্য দেশবাসীকে জমায়েত করার কাজে আরাে বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সূত্র: দেশের ডাক
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১