সাবাস! এগিয়ে চল!
সাবাস শ্রীমতী গান্ধী! শক্তিই জাতির প্রতীক আর বীরত্বই জাতির আদর্শ- ভারতবর্ষের অতীত ঐতিহ্য তথা লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রয়াস প্রত্যেকটি ভারতবাসীকে উন্মাদ-মুগ্ধ করিয়াছে। অন্যদিকে সমগ্র বিশ্বকে করিয়াছে বিস্মিত-স্তব্ধ ও বিস্ফারিত নেত্র। ইস্পাত দৃঢ় মানবতাবােধ নীতির উপর ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপ আজ বিশ্ব নেতৃত্বকে গতানুগতিক ভাবধারা পরিহার করিয়া যথার্থ মানবকল্যাণমূলক শান্তির তথা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের পথের নিশানা দিতেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজবাদ- কোনােটাই মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়া প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। কারণ সবার উপরে মানুষ আর মনুষ্যত্বই ভারত তথা ভারতবর্ষের মৌলিক উপাদান। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আজ বিশ্ব নেতৃত্বের অনেকেরই দুঃস্বপ্নস্বরূপ। ঐতিহাসিক বিবর্তন অপ্রতিরােধ্য। সেই বিবর্তনের পথে চন্দ্রগুপ্ত-চাণক্যের নতুন করিয়া আত্মপ্রকাশের এই উপযুক্ত সময়। নব পর্যায়ে অভিনব উপাদান লইয়া সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের এই তাে সুবর্ণ সুযােগ। ভারতীয় মৌলিক উপাদানে গঠিত এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান আলােকে উদ্ভাসিত শ্রীমতী গান্ধী এই সময় ও সুযােগের সদ্ব্যবহার করিতেছেন এবং করিবেনও। তাহার প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। বর্তমান সঙ্কটকালে তিনিই আমাদের এক ও অদ্বিতীয়া কর্ণধার।
সাবাস জোয়ান ভাইরা! আমাদের বাহাদুর জোয়ান ভাইদের প্রশংসা করিবার মতাে ভাষা অবিধানে নাই। আখাউড়া বিজয় আমাদের নিকট চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। এক রকম বিনা রক্তপাতে আমরা আখাউড়া জয় করিয়াছি বলিলে নেহাতই কম বলা হয়। এখানে বিনা রক্তপাত মানে অসামরিক লােকক্ষয়। আমাদের প্রত্যেকেরই বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এমনকি সামরিক বিশেষজ্ঞদেরও ধারণা ছিল যে, আখাউড়া ঘাঁটি একটি দুর্ভেদ্য পাক ঘাঁটি টুয়েন্টি ফার্স্ট ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট সেখানে ভূগর্ভ শিবির সংস্থাপন করিয়া ট্যাঙ্ক, কামান, রকেট, মর্টার প্রভৃতিতে ছিল পূর্ণায়ুধ। বলা হইত উহা নাকি ভিমরুলের চাক। উহাকে ঘাটাইলে আগরতলা শহরবাসীর আর রক্ষা নাই। আমরাও এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম যে, মুক্তিবাহিনী যে দিন (যদি কোনাে দিন) আখাউড়ায় আক্রমণ চালায় তবে কমপক্ষে শতকরা দশজন আগরতলা বাসীকে কামানের গােলায় প্রাণে মরিতে হইবে এবং শতকরা পঁচিশ-ত্রিশ জনকে লঘুগুরু আহত হইতে হইবে। অন্যদিকে এই ধারণাও বদ্ধমূল ছিল যে, কয়েক ব্যাটেলিয়ান রেগুলার আর্মি শহীদ না হইলে আখাউড়া দুর্গের ধারে কাছেও ঘেষিতে পারিবে না। মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা। ১ ডিসেম্বর রাত্রি আটটায় আখাউড়ায় কামান গর্জিয়া উঠিল। কামানের মুখগুলাে সবই শহর আগরতলার দিকে। এক দুই তিন গণণা করিতে না করিতেই পাল্টা গর্জন শুরু হইল আগরতলা হইতে। গর্জন প্রতিগর্জন গণনা সাধ্যাতীত। গর্জনের তুলনায় প্রতিগর্জনের বহর এবং সংখ্যাটাই ছিল অধিক। শেষ পর্যন্ত গর্জন প্রায় স্তব্ধ হইয়া যায়; কিন্তু প্রতিগর্জন ছিল অবিরাম অবিশ্রান্ত। আগরতলা হইতে অবিরাম বার ঘণ্টা মুষলধারে কামান গােলা আর রকেট বর্ষণের বেগ সহ্য করিতে না পারিয়া পাক কামান, আর ট্যাঙ্কগুলাে এ্যাবাউট টার্ন করিয়া সুর সুর করিয়া দুর্ভেদ্য বিবরে প্রবেশ ও আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। বস্তুত আখাউড়া জয় হইয়াছে বাহাত্তর ঘণ্টায় নহে, মাত্র বার চৌদ্দ ঘণ্টায়। ২ ডিসেম্বরই আখাউড়া দুর্গ স্তব্ধ হইয়া যায়। কিন্তু হইলে কী হয়, আমাদের জওয়ানদের পক্ষে সেই স্তব্ধতা অনুসরণ করিয়া সঙ্গে সঙ্গে সমর সম্ভারসহ (ট্যাঙ্ক, কামান প্রভৃতি) আখাউড়া যাওয়া সম্ভব হয় নাই। কারণ, পাকবাহিনী যথাসময়ে আখাউড়া প্রবেশ পথে তিনটি সেতু ধ্বংস করিয়া এবং যত্রতত্র মাইন পুতিয়া গিয়াছিল। আমাদের জওয়ানরা অতি ক্ষিপ্রতা এবং নিপুণ দক্ষতার সহিত যুগপত মাইন অপসারণ এবং সেতু নির্মাণ করিয়া আখাউড়া স্টেশন বীরদর্পে পদার্পণ করে ৪ ডিসেম্বর। আখাউড়া স্টেশন যখন ভারতীয় জওয়ানদের বীর পদক্ষেপে প্রকম্পিত পাক জঙ্গি ফৌজ তখন নয় ফুট মাটির নিচে ভূগর্ভ দুর্গে জবাইয়ের প্রহর গণনায় রত। দুর্ভেদ্য সেই দুর্গের প্রবেশ পথ খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব হয় নাই। সেখানেও ইতঃস্তিত অগণিত মাইন। আমাদের জোয়ানরা যখন মাইন উদ্ধার ও প্রবেশ পথ অনুসন্ধানে ব্যস্ত, সেই সময় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া হইতে কামানের গােলাবর্ষণ করে পাক গােলন্দাজ বাহিনী। তখনই তলব করা হয় ভারতীয় বিমান বাহিনীকে। একে একে চব্বিশটি মিগ ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার উপর বােমা বর্ষণ করিয়া সেই কামানকে শুধু স্তব্ধ করিয়াই দেয় নাই সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জয়ের পথও প্রশস্ত করিয়া দিয়াছে। ৫ ডিসেম্বর মাটি খুঁড়িয়া বিবরে লুকায়িত শৃগাল বৃত্তি ধারী ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের একুশ জন আর্মি অফিসার, শতাধিক রেগুলার আর্মি এবং শতাধিক আধা সামরিক লােককে খোঁচাইয়া বাহির করে। সকলেই আত্মসমর্পণ করিয়াছে। আমাদের বাহাদুর জোয়ানরা জঙ্গি ফৌজের প্রতি রীতিমতাে ভদ্র আচরণ করিয়াছে। যাহাকে ভারতীয় ঐতিহ্যে বলা হইয়াছে বীরের প্রতি বীরের আচরণ। যদিও পাক ফৌজ মুক্তিবাহিনীর সহিত পশুর ন্যায় দুর্ব্যবহার করিয়াছে, তথাপি আখাউড়া সেক্টরে কি মুক্তিফৌজ কী ভারতীয় ফৌজ কেহই আত্মসমর্পণকারীদের প্রতি পাল্টা পাশবিক ব্যবহার করে নাই। সাবাস! সাবাস আমাদের মানবিক সামরিক নীতিবােধ।
ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জোয়ান ভাইদের। তাহারা শতে শতে প্রাণ বলি দিয়া আমাদের (আগরতলাবাসীর) শরীরে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগিতে না দিয়া আখাউড়া জয় করিয়াছে— আমাদের আতঙ্কমুক্ত করিয়াছে। সার্থক বীরত্ব। এই বীরত্বের তুলনা হয় না। বিমান বাহিনীর সর্বাধিনায়কের সঙ্গে সুর মিলাইয়া আমরাও বলিতেছি- সাবাস! এগিয়ে যাও।
সূত্র: ত্রিপুরা
৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
২১ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮