বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ছয়মাস অতিক্রান্ত
গত ২৫ মার্চ রাত্রির অন্ধকারে যখন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, ছাত্র-যুবক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশ বাহিনীর উপর পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার মিলিটারি জুন্টা নির্বিচারে মেশিনগান, মর্টার, কামান, রাইফেল ও বােমা নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশবাসীকে হত্যা করে, তার বিরুদ্ধে সেই দিন থেকে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশের জনতার স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। আজকে সেই সংগ্রামের ছয় মাসকাল অতিবাহিত হয়ে গেল। গত ২৫ মার্চের পর এ পর্যন্ত ৯০ লক্ষাধিক বাংলাদেশবাসী দেশত্যাগ করে ভারত চলে এসেছেন।
বাংলাদেশের এই সংগ্রাম যখন শুরু হলাে সেই সময় থেকে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রদেশে প্রদেশে জনতা দাবি তুলেছেন, ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দাও। প্রস্তাব পাস করা হলাে রাজ্যের বিধানসভাগুলাে থেকে। ইন্দিরা সরকার বললেন, সরকার কোথায় যে স্বীকৃতি দেব? বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারও গঠিত হলাে কিন্তু এখনাে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ইন্দিরা সরকার এপ্রিল মাস থেকে মন্ত্রীদের বিদেশে পাঠাতে শুরু করলেন। কিন্তু তারা বাংলাদেশকে সমর্থনের কথা কোথাও বলেননি। শুধু শরণার্থীদের খিচুড়ির পয়সা দেওয়ার অনুরােধ জানালেন। এই পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের অগণিত যুবক-ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ও দেশপ্রেমিকরা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন।
১ জুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন দিক চিহ্ন হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ ও সংগঠন, বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী কৃষক নেতা মওলানা ভাসানীর পার্টিসহ গঠিত হলাে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার ও ব্যাপকতর করার জন্য আহ্বান জানালেন একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ে তােলার। গত লড়াই চলেছে আজ পূর্ব রণাঙ্গনের চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, কসবা, সিলেট, ময়মনসিংহে, উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, যশাের, খুলনায়, কুষ্টিয়ায়, মেহেরপুর, বাগেরহাট, মধ্যাঞ্চলের ঢাকা, শেরপুর, রায়পুর, টাঙ্গাইলে। এর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে যশাের ক্যান্টনমেন্ট দখল নিয়ে। এ লড়াইয়ে বাংলার সংগ্রামী যােদ্ধাদের জয়ের খবর হয়তাে কদিনের মধ্যেই বেরুবে। অধিকার করেছে দিনাজপুরের পচাগড়, খুলনার বসন্তপুর এবং কুষ্টিয়া।
এদিকে পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠছে। কারণ দীর্ঘ আট মাসের যুদ্ধে প্রায় দুই বিগ্রেড সশস্ত্র বাহিনী তাদের হারাতে হয়েছে। এক শিবপুর থানায় একটি মুক্তিবাহিনী স্কোয়াডের সাথে ৭টি সংঘর্ষে পাক বাহিনী একজন ক্যাপ্টেন, দু’জন অফিসারসহ ১১০ জন নিয়মিত সৈন্য হারিয়েছে, আহত হয়েছে প্রচুর। তাহলে একটি থানার পরিসংখ্যান দিয়ে অনায়াসেই হিসাব করা যায় পাকবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির চেহারা। অপরদিকে এই থানায় মুক্তিবাহিনী হারিয়েছেন ৩ জন সাথীকে। পাক বাহিনীর নবনিযুক্ত আধা সামরিক বাহিনী রাজাকারের ক্ষয়ক্ষতি অনেক। পাক বাহিনী যে বিরাট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার সবচেয়ে বড়াে প্রমাণ সামরিক শাসন থাকা সত্ত্বেও সারা পাকিস্তান জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘােষণা, নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী প্রবীণ কৃষক নেতা মওলানা ভাসানী পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই দলের প্রথম সারির নেতাদের। পাক বাহিনী আজ শেষ মরণ কামড় দেয়ার জন্য হয়তাে ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। অবশ্য ইতিমধ্যে তার প্রস্তুতি হিসেবে ভারত সীমান্তের বহু অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের শতকরা নব্বই জন মানুষের সমর্থন রয়েছে। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খাদ্য দিচ্ছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন সর্বোপরি নিজের ছেলেকে পাঠাচ্ছেন লড়াইয়ের ময়দানে। বাংলাদেশ মানুষ এ-লড়াই থেকে আর একটি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, এ লড়াইয়ে কারা তাদের বন্ধু। যারা দেশের বাইরে থেকে শুধু কথার ফুলঝুরি ছােটাচ্ছেন তারা? না যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রতিটি লড়াইয়ের জয় পরাজয়কে সমভাগি হিসেবে গ্রহণ করছেন তারা।
এদিকে যতই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম তীব্র হচ্ছে ততই আন্তর্জাতিক সামাজ্যবাদী চক্রান্ত এই লড়াইকে বানচাল করার জন্য কুটিল ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। এদের মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রধান। এরা ইয়াহিয়া খানকে এখনাে অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে বাংলার বুকে আরাে রক্তাক্ত ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামকে পেছনে ফেলে রেখে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধ জিগির ছড়াচ্ছে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র পলিটব্যুরাে এই চক্রান্তকে ব্যর্থ করার লক্ষ্য নিয়ে দাবি তুলছেন বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দাও। স্বীকৃতি দিলে যদি যুদ্ধ বাধে তবে যুদ্ধ করতেও আমরা প্রস্তুত। পলিট ব্যুরাে আরাে বলছেন, যদি প্রথমাবস্থায় স্বীকৃতি দেওয়া হতাে তাহলে যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকতাে না, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্র ও কুটিল ষড়যন্ত্র করার সময় পেত না। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে সজাগ থাকতে হবে, আমাদের দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক মানুষের দাবি স্বাধীন বাংলাদেশ। সুতরাং আমাদের দেশের সরকার যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কোনাে বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে।
গত আট মাসে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজি, জোতদার, জমিদার ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, যে লড়াইয়ের পেছনে আছে ভারতবর্ষের পঞ্চান্ন কোটি গণতান্ত্রিক মানুষের সমর্থন যে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন পুত্র হারা পিতা, পিতা হারা পুত্র, মা-বােন হারা যুবক, ঘর-বাড়ি লুণ্ঠিত গৃহহারা অগণিত জনতা, সেই লড়াই অবশ্যই সমস্ত প্রকার দেশি-বিদেশি চক্রান্তকে পরাস্ত করে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার লড়াইয়ের মাধ্যমে জয়ী হবেন।
সূত্র: দেশের ডাক
০৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮