আমাদের কী করা উচিত?
গুলিগােলা পড়িতেছে। এমন একটি দিন যায় না যে গুলিগােলা পড়ে না এবং ঐ গুলিগােলার আঘাতে কমবেশি নিহত ও আহত হইতেছে না। পূর্ব পাকিস্তান হইতে ত্রিপুরার উপর প্রত্যহ গুলিগােলা আসিয়া সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারীদের জীবন-যাপন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছে। মেশিনগান, লঘু মেশিনগান, আর্টিলারি এবং ভারী কামানের গােলার আঘাতে সীমান্ত অঞ্চলের বহুলােক নিরাপত্তার প্রশ্নে সাময়িক বা অস্থায়ীভাবে আবাসস্থল পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছে। এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে সদা-সর্বদার তবে পাক গুলিগোলা বর্ষণ হয়। বড় রকমের ভারী কামানের গোলাবর্ষণ হইয়াছে গত ২৬ জুলাই সীমান্ত নিকটতম মহকুমা শহর সােনামুড়ার উপর। আশি পাউন্ডের ১০/১২ রাউন্ড কামানের গােলা। বেলা তখন একটা। অফিস, আদালত, স্কুল, কাচারি প্রভৃতিতে পুরাদমে কাজ চলিতেছে সময়ে একের পর এক আটাশ মিনিট কামান গর্জনে শহরবাসীদের একেবারে তছনছ করিয়া দিয়ােছে। প্রশাসন যন্ত্র হতভম্ব। প্রশাসক দিশাহারা। লােকজন যে দিকে পারে দৌড়াইতেছে। সকলেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, কম্পাউন্ডার সবই অদৃশ্য। বিজলি সরবরাহ বন্ধ। সন্ধ্যার দিকে গােটা শহরটা প্রায় জনমানব শূন্য; আলােহীন প্রেত নগরের মতাে। পরদিন সকালের দিকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেলা ১০টা পর্যন্ত অবিরাম মেশিনগানের গুলি বর্ষণের শব্দ শ্রুত হয়। সকলেরই ধারণা জন্মে যে, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকি আর্মির সম্মুখ সংগ্রাম চলিয়াছে। ইহাতে অনেকে হৃত মনােবল ফিরিয়া পাইলেও ভবিষ্যতের জন্য অধিকতর চিন্তিত ও শঙ্কিত হইয়া পরিবারের নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিরাপদ দূরত্বে প্রেরণের ব্যবস্থা করিতে সকলেই ব্যগ্র ছিল। প্রশাসন যন্ত্র তখনও বিকল। ভীত, সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত জনসাধারণকে বল-ভরসা দিবার কোনাে ব্যবস্থা কেহই করেন নাই। রাজনৈতিকজন নেতাগণ সকলেই সপরিবারে উধাও। মহকুমা শাসক জেলা শাসকের নির্দেশের অপেক্ষায় গােটা দিনটা অতিবাহিত করিলেন। ২৮ জুলাই শুভ প্রভাতে শহরের আবহাওয়ায় সাহসিকতার মৃদু হাওয়া বহিতে আরম্ভ করে। বিভিন্ন সূত্রে জনতা জানিতে পারে আমাদের তরফ হইতে পাকবাহিনীর গােলাবর্ষণের সমুচিত জবাব দেওয়া হইয়াছে; যে কারণে পাক-ভারত সীমান্তে স্তব্ধতা বিরাজ করিতেছে। অর্থাৎ জনমনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছে যে, আমরাও প্রস্তুত। চোখের উপর জনতা আরও দেখিতে পাইল কতক্ষণের মধ্যে গােয়েন্দা তৎপরতায় ষাটজন পাক গুপ্তচর মালামালসহ ধরা পড়িয়াছে। ভারত কর্তৃক ‘শঠে-শাঠাং’ অর্থাৎ যেমন কুকুর তেমন মুগুর নীতি অবলম্বিত হইয়াছে প্রত্যক্ষ করিয়া জনতার বুক সাহসে ভরিয়া উঠিল। ভয়-ভীতি আর বিভ্রান্তির জাল ছিন্নভিন্ন করিয়া জনসাধারণকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়া আসিতে প্রেরণা যােগায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বলা অনাবশ্যক এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অসামরিক (তথা ত্রিপুরা সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নহে, সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আভাষ ইঙ্গিত। অর্থাৎ জনতার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছে যে, অতঃপর আর আকাশ হইতে একতরফা মৃত্যু নামিয়া আসিয়া ত্রিপুরাবাসীর ঘাড়ে চাপিয়া বসিতে পারিবে না। আকাশ পথেই পাল্টা অভিযান চলিবে। তথাপি আত্মরক্ষার প্রশ্ন থাকিয়া যায়। মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশ উদ্ধারে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। তাহাদের দুর্ধর্ষ আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী ক্ষতবিক্ষত ও বিধ্বস্ত হইয়া পড়িয়াছে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা পরিমাপ করা যায় ই আর্তনাদের মধ্যে। ইয়াহিয়া খাঁ যখনই বেসামাল হয় তখনই ভারতের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছাড়ে। পাকবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরিষ্কার বােঝা যায় পাকবাহিনী এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে নিশ্চিত মৃত্যুবরণকে এড়াইবার নিমিত্ত ভারতকে খোঁচাইয়া যুদ্ধে নামাইতে চায়। উদ্দেশ্য অতি সহজ এবং সরল। বীরের সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাজিত হইয়াও প্রাণে বাঁচা যায় আত্মসমর্পণ করিয়া। মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিতের মর্যাদা পাওয়ার কোনাে আশাই তাহারা করে না বা করিতে পারে না; কারণ তাহারা বাংলাদেশে বীরের বা প্রকৃত যােদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় নাই- তাহারা নরঘাতক, লম্পট, দস্যু, তস্কর ও জহলাদের কাজ করিতেছে। অতএব কর্মানুযায়ী ফলই তাহাদের প্রাপ্য; মুক্তিবাহিনী তাহাই করিতেছে। পাকবাহিনীর খোঁচাখুঁচি (অর্থাৎ সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় অঞ্চলে পাকগুলিগােলা) বৃদ্ধির অর্থ হইল মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি। ধরিয়া লওয়া যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়িবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতের উপর পাক গুলিগােলাও সেই অনুপাতে বাড়িবে বৈ কমিবে না। পাক জঙ্গিশাহীর এই প্ররােচনামূলক গােলাগুলির হাত হইতে আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে সামরিক প্রতিরক্ষার সঙ্গে অনতিবিলম্বে রাজ্যমধ্যে অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও চালু করা উচিত ছিল। ত্রিপুরা প্রশাসন তাহা করেন নাই বলিয়াই সােনামুড়াতে প্রশাসনিক ব্যর্থতার নগ্ন মূর্তি সর্বসাধারণের নিন্দা, ভৎর্সনা ও উপহাসের খােরাক যােগাইয়াছে। কথায় বলে বুদ্ধিমানে ইঙ্গিতে বুঝে, বােকায় বুঝে কিলে; ভারত সরকারকে পূর্ব বাংলার দানবীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে তৎপর হইতে দেখিয়াও আমাদের সরকার উহার আনুসাঙ্গিক বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগঠিত করিবার প্রয়ােজন অনুভব করেন নাই; এমনকি কিল খাওয়ার (সােনামােড়ার) পরেও দেখা যায় ত্রিপুরা সরকারের উপলব্ধির ঘট উপুড় হইয়াই আছে। এই অবস্থার অর্থাৎ প্রশাসনের বােকারও অধম ভাব কাটাইবার জন্য আমাদের কী করা উচিত?
সূত্র: ত্রিপুরা
৪ আগস্ট, ১৯৭১
১৯ শ্রাবণ, ১৩৭৮