জয় বাংলার জয়
ওপার বাংলায় যা ঘটেছে, যে অমানুষিক নির্মম অত্যাচার চলছে, ইতিহাসে তার তুলনা নেই। কিন্তু জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়া সরকার সর সময় বলেছেন—এসব তাদের ঘরােয়া ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বের সভ্য মানুষ এই বর্বরােচিত অনাচার নীরবে সহ্য করতে পারেন না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমেই সব কিছু স্থির হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সকলেরই আছে তাই উপনিবেশবাদ এ যুগে অচল। সাম্প্রতিক নির্বাচনে শেখ মুজিবরের জয়, বাংলাদেশের জনগণের জয়। কিন্তু জনগণের সেই রায পদদলিত করে আসূরিক শক্তি প্রয়ােগে সাম্রাজ্যবাদ স্থায়ী রাখবার প্রয়াস বেশীদিন চলতে পারে না। ওপার বাংলার বীর জনগণ অস্ত্রহীন, তবু তাদের ঐক্য ও মনােবল সকল গােলাগুলী স্বন্ধ করে দেবে একদিন। জয় বাংলার জয় সেই দিন আসবেই। লক্ষ শহীদের শােনিত আর অস্থি দিয়ে রচিত হবে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ।
ইতিহাসে একটি নতুন রাষ্ট্রের শুভ নব জন্মের শঙ্খধ্বনি আমরা শুনতে পেলাম। স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ তার আবির্ভাব ঘােষণা করেছে। স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র তার আভ্যন্তরীণ নীতির ভিত্তি। মৈত্রী ও ভ্রতৃত্বের বৈদেশিক নীতির স্তম্ভ।
বাংলাদেশে মুজিবর রহমান জনগণ-মন অধিনায়ক। তার ও তার আওয়ামী লীগের অনুগামীবৃন্দের মন্ত্রই হচ্ছে জাগ্রত জাতীয়তাবাদ। জাতীয় আওয়ামী দল ও তাদের নেতা ভাসানী ও তােহা চালিত সাম্যবাদ ঘেঁষা দলের মূল মন্ত্র ছিল চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদ ও আরও নানা মতবাদের স্রোত আজ একাকার হয়ে মিশে গেছে। প্রত্যেকের হৃদয়ের একান্ত প্রার্থনা ও আকুতি বাংলাদেশের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সফল হােক। দেশ বিভাগের পর থেকে আগত অগণিত উদ্বাস্তু মানুষের শতকরা ৮০ ভাগের প্রার্থনা দুই বাংলার একীকরণ। দুই দেশ নয় বাংলাদেশ মানে একটি মাত্র দেশ। দুটি হৃদয় নয়। একটি হৃদয়। আর পশ্চিম বাংলার আদি বাসিন্দা, বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে যারা বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল-তারা প্রাক দেশ বিভাগ যুগের দুঃস্বপ্নের দিনগুলি এখনাে ভুলতে পারেননি। তাঁদের কামনা দুই বাংলা মৈত্রী ও শুভেচ্ছার বন্ধু আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই বাংলা। এ যুদ্ধের আশু নিষ্পত্তি ঘটলে এবং মুজিবরের অনুগামীদের জয় হলে বাংলাদেশের ও আমাদের লাভ ষােল আনা। ১২০০ মাইল অশান্ত সীমান্তের নিয়ত রক্ষার গুরুভার থেকে আমরা রেহাই পাব। অবাধ বাণিজ্য চালু হলে বাংলাদেশের পাট, চা, চমড়ার জন্য আমরপা মুক্তাঙ্গন সৃষ্টি করব। পশ্চিম পাকিস্তান এতদিন ধরে বাংলাদেশকে শিল্পে অনগ্রসর করে রেখেছিল। পাকিস্তানের শিল্প সম্পদের শতকরা ৬৬ ভাগ, বীমা সংস্থানের শতকরা ৭০ ভাগ এবং ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত লভ্যাংশের শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ভােগ করেছে। নিম্নে বর্ণিত তথ্যে সরকারের নির্মম পক্ষপাতিত্ব ধরা পড়ে ঃসরকারি কর্মচারীদের শতকরা ভাগ—
বিভাগ | পশ্চিম পাকিস্তানি | পূর্ব বঙ্গীয় |
প্রতিরক্ষা | ৯৯-৯ | ৮-৯ |
স্বরাষ্ট্র | ৭৭-৫ | ২২-৫ |
কৃষি | ৭৯-০ | ২১-০ |
শিল্প | ৭৪-৩ | ২৫-৭ |
শিক্ষা | ৭২-৭ | ২৭-৩ |
স্বাস্থ্য | ৮১-০ | ১৯-০ |
অর্থনৈতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে কি সরকারি দক্ষিণ্য বণ্টন নীতিতে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববাংলাকে ঔপনিবেশিক মাগয়াভূমিতে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে স্থায়ীত্বদান করতে পারলে তার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনের পুণরুজ্জীবনে আমরা নিঃসন্দেহে অংশীদার হব। অবাঙ্গালী মুসলমানদের দৃষ্টিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিভীষিকাময়। কারণ সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় গরমিল এবং অন্যান্য অসুবিধা ছাড়াও তাদের সব চাইতে বড় দুঃস্বপ্ন হােল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি নিরলম্ব হয়ে পড়বে। বাঙ্গলী মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে, বিশেষ করে যারা আন্ত: ইসলামীয় রাষ্ট্রজোট কল্পনায় বিভাের, তারাও পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন দেখে হয়ত দিশেহারা বােধ করছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ মে ১৯৭১