You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.01 | শরণার্থীদের একটা বিরাট প্রশ্ন তুলে ধরেছেন | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থীদের একটা বিরাট প্রশ্ন তুলে ধরেছেন

ভারতের ওপর বাংলাদেশের ঘটনার প্রচণ্ড প্রভাব পড়বে প্রধানমন্ত্রী শ্ৰমতী গান্ধী ঠিক কী ভেবে এ কথা বলেছিলেন তা আমরা জানি না। রাজনীতির পন্ডিতেরা তার বিচার করেন। কিন্তু সীমান্তের ওপারে ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাভিযানের অন্ততঃ একটি অকরুন প্রতিক্রিয়া যে একেবারে আমাদের বুকে এসে বিধেছে, এ-কথা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। ভিটেমাটি ছেড়ে যে নর-নারী-শিশুর স্রোত প্রতিদিন এপারে এসে আশ্রয়ের আশার আছড়ে পড়ছে তার মােট সংখ্যা এখন আট লাখ অথবা দশ লাখে পৌচেছে তা নিয়ে কালক্ষেপ করা বৃথা। এই নতুন শরণার্থীদের মধ্যে কোন ধর্মাবলম্বী কতাে জন আছেন, তা বিচারের সময়ও এখন নয়। যা এখন বাস্তব ও উদ্বেগজনক সত্য তা হল, একটি মধ্যযুগীয় বর্বর জঙ্গীশাহীর অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই ভারতীয় এলাকায় এসেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যতােই দীর্ঘায়িত হবে ততই এই স্রোত ক্রমশঃ প্লাবনের আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতাে সৎসাহস যদিও আমরা এখনও দেখাতে পারি নি, তবু সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই জীবন-মরণ সংগ্রামের নৈতিক সমর্থন দানের ঔদার্য আমাদের সরকার এখনও হারান নি। সেই জন্যেই সীমান্তের আগল বন্ধ করে যেহেতু এই নিরপরাধ মানুষগুলিকে আমরা নেকড়ের মুখে ছেড়ে দিতে পারি না, তাই দু’হাত বাড়িয়ে এদের আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নৈতিক সমর্থনের যে মূল্যই থাকুক না কেন, যে সব মানুষ নিদারুণ ঝুকি নিয়েও দেশ ছেড়ে এখানে এসে সীমান্তের শিবিরে অথবা আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, শুধু মৌখিক সহানুভূতিতে তাদের কোনাে দুঃখলাঘব হবে না। পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে এই সব মানুষ এসে পড়েছেন বলেই এদের দায়িত্ব শুধু এই চারটি রাজ্যেরই হতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকার এদের ত্রাণের সব রকম দায়িত্ব নেবেন বলে ঘােষণা করেছেন এবং কলকাতার কেন্দ্রীয় ত্রাণ-দপ্তরের একটি পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় খােলার কথাও হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সরকারি ঘােষণা ও তা রূপায়ণের মধ্যে আমল তান্ত্রিক আলস্য যে একটা বিরাট রাধা হয়ে দাঁড়ায়, এক্ষেত্রেও কি আমরা সেই দৃশ্যের পুনরভিনয় দেখতে পাব? দেশভাগের পর শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে এবারের এই শরণার্থীদের সমস্যার একটা উল্লেখযােগ্য পার্থক্য কখনােই দৃষ্টি এড়াতে পারে না। নতুন শরণার্থীরা এদেশে পাক-পাকিভাবে থাকতে আসেন নি বলে সরকার তাদের সীমান্তের কাছেই শিবিরে রাখার সিদ্ধান্ত করেছেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের জন্যেই সরকারের ওপর যে নতুন ধরনের দায়িত্ব চেপেছে তা পালন সমন্ধে সরকার কি যথেষ্ট মনােযােগ দিচ্ছেন? শরণার্থীদের যখন অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না, তখন সীমান্তবর্তী পরিমিত এলাকাতেই এই লক্ষ লক্ষ মানুষের দিনযাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থান যেহেতু পরিমিত সেহেতু স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা একটা বিরাট সমস্যা, বিশেষতঃ বর্ষার যখন খুব বেশি দেরি নেই। কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় সমবেত এতগুলি মানুষকে নিয়মিত খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের সমস্যাও কম গুরুতর নয়। এই সব কাজের জন্যে যে কেন্দ্রীয় সরকারের টাকার অভাব হবে না, সেটাই বড় কথা নয়, সব চেয়ে বড় প্রয়ােগন সংগঠনের এবং নিরাশ্রয় মানুষগুলির প্রতি মানবিক ব্যবহারের। বেশ কিছু দিন আগেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডা: ত্রিগুণা সেন এই সব সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিলেন। এই সব সমস্যার যথাযথ সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের আরাে একটি দায়িত্ব দেখা দিয়েছে, কারণ শরণার্থীর ছদ্মবেশে পাক জঙ্গীশাহীর অনেক গুপ্তচরও যে দুরভিসন্ধি নিয়ে এপারে ভীড় করছেন, এ কথাও এখন অজানা নয়। এরা যাতে কোনাে রকমেই কোনাে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্যে সরকার কতটা সতর্ক হয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থদের ত্রাণের জন্যে আন্তর্জাতিক সাহায্যের দাবি অনেকের মতাে আমরাও জানিয়েছি। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশে জাতিহত্যার নিন্দা করার মতাে সাহস দেখাতে পারেনি, তেমনই এই নিরাশ্রয় মানুষদের সাহয্যের জন্যে কোনাে আন্তর্জাতিক হাতও এ পর্যন্ত প্রসারিত হয়নি। সে আশায় বসে থাকাও এখন বােধ হয় মূড়তা, কারণ অন্যান্য দেশের সুপ্ত বিবেক আদৌ জেগে উঠবে কিনা তা আমরা জানি না। সুতরাং ভারত চাক বা না-চাক, এই ছিন্নমূল নরনারী এখন তাদের জীবনধারণের জন্যে ভারতের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন। এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লীকে একটি কঠোর সত্যের মুখােমুখি দাঁড়াতে হবে। আমরা ভাবছি, অবস্থা স্বাভাবিক হলেই এই শরণার্থীরা আবার স্বদেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু অবস্থা স্বাভাবিক মানে কী? ইয়াহিয়ার হানাদারদের জয় অথবা মুজিব বাহিনীর জয়? মুজিব বাহিনীর যদি পরাজয় ঘটে তবে কি শরণার্থীর সংখ্যা খুব শীগগিরই লক্ষের অঙ্ক ছাড়িয়ে কোটিতে পৌছবে না? এই সঙ্কট থেকে যদি ভারত সরকার মুক্তি পেতে চান, তবে তাদের সামনে একটি মাত্র পথই খােলা আছে মুক্তিফৌজের জয় সুনিশ্চিত ও তুরান্বিত করা। এবং সেই পথে প্রথম পদক্ষেপ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দান।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ মে ১৯৭১