পিন্ডির নিজের ভাষায় জবাব চাই
রাওয়ালপিন্ডির ফৌজী শাসকদের দূঃসাহসের সীমা নেই। এক মাস ধরে বাংলাদেশের বুকের উপর উম্মত্ত তান্ডবে দাপাদাপি করেও তারা বিদ্রোহীদের শায়েস্ত করতে পারে নি। তাদের কূটনৈতিক কর্মীরা একজনের পর একজন পিন্ডির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাদের মুখে চুণকালি মাখাচ্ছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা তাদের বর্বর অত্যাচারের কাহিনী ফাঁস করে দিয়েছেন, কোন কোন দেশের পার্লামেন্ট সদস্যরাও মুখ খুলতে আরম্ভ করেছেন। অথচ, ভারতবর্ষকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে যাওয়ার সখ ইয়াহিয়া ও তার স্যাঙ্গাতদের আর মিটছে না। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তাদের এই গল্পকাহিনী দুনিয়ার বাজারে বিকোয় নি। এখন ইয়াহিয়ার মিলিটারি হানাদাররা এতখানি মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা ভারতবর্ষের সীমান্তের ভিতরে ঢুকে ভারতীয় নাগরিদের হত্যা করতে ও গ্রাম জ্বালিয়ে দিতেও পিছপাও হচ্ছে না। এর আগে সীমান্তে র অপর পার থেকে পাকিস্তানি সৈন্যের গােলাগুলি ছুটে এসে ভারতীয় এলাকার মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। ত্রিপুরায় একজন তহশীলদারও নিজের বাড়ীর বারান্দায় বসে থেকে আহত হয়েছেন। কিন্তু মঙ্গলবার কোচবিহার জেলায় ছিটমহলে ও চব্বিশ পরগণা জেলার ধররা সীমান্তে যে ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এই দুই ঘটনাতেই পাকিস্তানি সৈন্য জেনেবুঝে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় এলাকার মধ্যে প্রবেশ করে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর তাদের বিক্রম দেখিয়ে গেছে। একদিনের এই দুটি ঘটনাতে তারা অন্তত ৩১ জনের প্রাণ নিয়েছে। এই দুটি ঘটনা ভারতবর্ষের পৌরুষ, তার রাষ্ট্রসত্তার প্রতি একটা প্রকান্ড চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান যদি ভেবে থাকে, সে এইসব জাল পেতে ভারতকে জড়িয়ে ফেলবে, তাহলে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে, সে মাকড়সার জালে ঈগল ধরার বৃথা চেষ্টা করছে।
এই চ্যালেঞ্জের সামনে ভারত সরকার এখন কি করবেন? ভারতবর্ষের বুকের উপরই বিদেশী সশস্ত্র আক্রমণকারীর আঘাত যেখানে ভারতীয়ের রক্তে দেশের মাটি লাল হচ্ছে, সেখানে এই দেশের সরকার কি করবেন? কিন্তু তারও আগেকার প্রশ্ন হল, এই জিনিস সম্ভব হল কিভাবে? যে বর্বর বাহিনী দেশের ঐক্যরক্ষার নামে গনহত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালিয়ে যেতে পারে তাদের কাছে থেকে কোন হঠকারিতাই অপ্রত্যাশিত নয়, একথা আগে থেকে অনুমান করা আদৌ অসম্ভন ছিল না। তবু সীমান্ত পার হয়ে এই হানাদাররা এল কি করে? এবং তাদের দুষ্কর্ম সেরে নিবিঘ্নে চলে গেল কি করে? ভারতবর্ষের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম কঠোর ভাষায় বলেছেন, “ভারত কারও সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে চায় না, তবে যুদ্ধ যদি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা তার যােগ্য জবাব দেব।” ভাল কথা। কিন্তু শুধু এই ধরনের কড়া কথায় পাকিস্তান জব্দ হবে না, এই দেশের মানুষও সন্তুষ্ট হবে না। সবচেয়ে প্রথম কথা হল, ভারতবর্ষের মানুষ দেখতে চায় যে, এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। আবার যদি ইয়াহিয়ার দস্যুরা এই দুঃসাহস দেখাবার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের একজনও যেন সশরীরে ফিরে যেতে না পারে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানকে একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে, আর একবার যদি এমন কিছু হয়, তাহলে ভারতীয় সীমন্তপ্রহরীরা পাকিস্তানের ভিতরে গিয়ে তার বদলা নিয়ে তার বদলা নিয়ে আসবে। কাশ্মীরে অসামরিক ছদ্মবেশধারী সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের তাড়া করে ভারতীয় সৈনিকরা যদি পাকিস্তানের ভিতরে গিয়ে আক্রমণকারীদের যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দিয়ে আসতে পারে, তাহলে পূর্ব সীমান্তে অনুরূপ ঘটনায় ভারতের হাত গুটিয়ে বসে থাকা কোন কারণ নেই। পিন্ডি যে ভাষা ভাল বােঝে, সেই ভাষায়ই তাকে জবাব দিতে হবে। বারাে বছরের বালিকা হারুবালা দাসী, দুর্গাপদ মালাে, সমসের মন্ডল প্রভিতির মৃত্যু রক্তের অক্ষরে এই কথাই লিখে দিয়ে গেছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৯ এপ্রিল ১৯৭১