You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.28 | নয়াদিল্লীর খাটি দাওয়া | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

নয়াদিল্লীর খাটি দাওয়া

কূটনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ইসলামাবাদ। প্রকাশ্যে বলছেন, জেনিভা কনভেনশন তারা মেনে নিয়েছেন। ঢাকার ভারতীয় মিশনের কর্মীরা নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবেন। গােপনে নির্দেশ দিয়েছেন পাক-কর্মচারীদের। শুধুমাত্র ঢাকা কেন পাকিস্তানে কর্মরত কোন ভারতীয় কূটনৈতিকই যেন পাকিস্তান ছাড়তে না পারেন। ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশনার শ্রী বি কে আচার্য হস্তক্ষেপ না করলে তাকে আটক থাকতে হত পাকিস্তানে। ঢাকার ভারতীয় মিশনের কর্মীরা কার্যতঃ এখন ইসলামাবাদে বন্দী। কূটনৈতিক ভবনটিও হয়ত যাবে ইয়াহিয়ার দখলে। শেষ মুহূর্তে শয়তানী চাল চেলেছিলেন পাক-কুচক্রী দল। তাদের দাবী জনাব হােসেন আলীসহ কলকাতার প্রাক্তন পাক মিশনের সব কর্মীকে পাঠাতে হবে। পাকিস্তানে। বিনিময়ে ভারত ফেরত পাবে তার ঢাকার কূটনৈতিক কর্মীদের। নয়াদিল্লী আমল দেন নি ইসলামাবাদের কথায়। জনাব হােসেন আলী এবং তার বাঙালী সহকর্মীরা দখল করেছেন পাক- ডেপুটি হাই-কমিশন ভবন। তারা এখন স্বাধীন বাংলা দেশের প্রতিনিধি। যে ভবনটি তাদের করায়ত্ত তা পাকিস্তানি টাকায় গড়া ইসলামাবাদের নিজস্ব ভবন নয়। ওটা ভাড়াটে পাল্টিয়েছেন। এ সমস্যার ফয়সালা হতে পারে আদালতে, গায়ের জোরে নয়।
ব্যর্থ হয়েছে ইয়াহিয়ার চাল। নয়াদিল্লী নিয়েছেন কড়া ব্যবস্থা। পাক কূটনৈতিকদেরও এখন খুশীমত ভারত ত্যাগ নিষিদ্ধ। বাস্তব অবস্থা পরিষ্কার। পাকিস্তানে ভারতীয় মিশনগুলাের কর্মীরাও নয়াদিল্লীর নজরবন্দী। ষােল আনা চিল অবস্থা। এ ধরনের কূটনৈতিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথ একেবারে বন্ধ। আন্ত র্জাতিক সম্পর্ক খানিকটা পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বসভঙ্গ করেছেন ইসলামাবাদ। তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতির কোন মূল্য নেই ভারতের কাছে। আশার কথা এতদিন পরে এই সহজ সত্যটি বুঝেছেন নয়াদিল্লী। হয়ত কোন তৃতীয় রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে মধ্যস্থতা করতে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু পাকসদাচারের বাস্তব রূপায়ণ ছাড়া কোনমতেই রেহাই পাবেন না ইসলামাবাদ। তাতে যদি পাক-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের পুরােপুরি ছেদ পড়ে, পড়ক। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং তার জন্যে। কদিন আগেও ইসলামাবাদের দৃষ্টিতে জনাব হােসেন আলী এবং তার বাঙালী সহকর্মীরা ছিলেন দুস্কৃতকারী। প্রাক্তন পাক- ডেপুটি হাইকমিশন ভবন থেকে তাদের উচ্ছেদ চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। আজ তাঁদেরই বলা হচ্ছে পাক-কূটনৈতিক কর্মী। ওদের ফেরত চাচ্ছেন পাক-স্বৈরাচারী গােষ্ঠী। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চলছে ইসলামাবাদের রঙ বদল। ওরা এখন দিশাহারা। দুনিয়ার সর্বত্র পাক-শাসকদল কামড় দিতে চাচ্ছেন যেখানে সেখানে। প্রথম কামড় এসে পড়েছে ভারতের উপর। নয়াদিল্লী সতর্ক ছিলেন বলেই দাঁত বসে নি। নইলে জলাতঙ্ক রােগে ভুগতে হত। দুনিয়ার কল্যাণের জন্যই বিষদাঁতগুলাে উপড়িয়ে ফেললা দরকার। কূটনৈতিক লড়াই-এর প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের সূচনার দেরী নেই। মাঝখানে রয়েছে বাংলা দেশ এবং তার স্বাধীন সরকার। একে কেন্দ্র করেই দানা বেঁধে উঠেছে পাক-ভারত উত্তেজনা। যত দিন যাবে এ উত্তেজনা তত বাড়বে। ওপরে অবিশ্রান্ত ধরায় বইছে রক্তস্রোত। পাক-বর্বরতায় ভাটা পড়ার লক্ষণ নেই। বাংলা দেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-এ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ভারতীয় জনতা এবং কেন্দ্রীয় সরকার। সংসদের প্রস্তাবে তাদের মনােভাব প্রতিফলিত। চুপচাপ বসে থাকা অর্থহীন। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দান নৈতিক কর্তব্য। বৃহৎ শক্তিগুলাের মুখের দিকে চেয়ে কালহরণে লাভ নেই।ওদের ঘাড়ে পড়ছে না শরণার্থীর বােঝ। ওদের ভূখণ্ডে পড়ছে না পাক-কামানের গােলা। ওদের কূটনৈতিক কর্মীরা বন্দী দশায় কাল কাটাচ্ছেন না পাকিস্তানে। ভারতের সমস্যা এবং নিরাপত্তায় প্রশ্ন স্বতন্ত্র ধরনের। এই স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতেই নিতে হবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলা দেশকে অন্ততঃ ডি ফ্যাটো স্বীকৃতি দান বিষদাঁত ভাঙ্গার আনুষাঙ্গিক হাতিয়ার। তারপর যদি দরকার পড়ে নিতে হবে অন্য হাতিয়ার। জনাব হােসেন আলীর জয় বাংলা মিশন অবশ্যই থাকবে কলকাতায়। তাদের উচ্ছেদ অসম্ভব। চুলােয় যাক পাক-সামরিকচক্র। ক্ষ্যাপা কুকুরের একমাত্র ওষুধ শক্ত লগুড়। এ অস্ত্র হাতে আস্ত রাখব না। তাহলেই ওদের পাগলামী থামবে। বন্ধ হবে বাংলা দেশের গণহত্যা। বাস্তব হয়ে উঠবে জয় বাংলা এবং দেশের গণহত্যা। বাস্তব হয়ে উঠবে জয় বাংলা এবং ভারতের নিরাপত্তা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১