মৌখিক ঘােষণা নয়, আরাে কিছু দরকার
বৃটিশ শ্রমিক দলের এম. পি মি: ব্রুস ডগলাসম্যান এবং নিউজিল্যান্ডের শ্রমিক দলের এম. পি মি:: ট্রেভর ইয়ংয়ের কণ্ঠস্বরই প্রথম আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর য জোরালাে, দ্বিধাহীনভাবে বাংলাদেশের স্বপক্ষে উচ্চারিত হলাে। যদিও তাদের সােমবারের এই ঘােষণঅ এসেছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক মাস অতিক্রান্ত হবার এবং কয়েক লক্ষ মানুষের হত্যার পর তবু তারা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র। কেননা তারা শুধু বাংলাদেশে যারা গণন্ত্র আর স্বাধীকারের জন্যে লড়াই করেছেন তাদের প্রতিই নৈতিক সমর্থন জানাননি, বিশ্বের মানবিকতার চেতনাকে সম্ভবত অর্গলমুক্ত করেছেন। আমরা কি আশা করতে পারি, বিশ্বের সর্বত্র যারা অন্যায়, অত্যাচার নিপীড়ন আর শােষণের বিরুদ্ধে দিনরাত অশ্রু বিসর্জন করে থাকেন, তাঁরা এই দুই জননেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশের বীভৎস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সােচ্চার হবেন? কিন্তু বাংলাদেশ শুধু মৌখিক সহানুভুতি চায় না। যখন মানুষ মরছে, যখন একটা জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্যকে ধ্বংস করবার জন্যে সুপরিকল্পিত হানাদারেরা ছড়িয়ে পড়েছে, যখন মেশিনগানের গুলীতে আর বুটের তলায় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে, যখন একটা নিরস্ত্র জাতি একদল সুসজ্জিত হুনের হাত থেকে তাদের স্বাধীকার, তাদের স্বাধীনতা, তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে অসমান লড়াইয়ে নিমগ্ন, তখন মৌখিক সহানুভূতি দেখানাের চাইতেও বেশি কিছু করা দরকার। মি: ডগলাসম্যান ও মি: ইয়ং যে ছ-দফা ঘােষণা প্রচার করেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক ও জরুরী এবং তার ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত প্রয়ােজন। যারা হানাদার, যারা গণতন্ত্রের শত্রু যারা গণহত্যায় প্রবৃত্ত তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়াবার নৈতিক কর্তব্য রাষ্ট্রসঙ্রে সদস্যভূক্ত প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা জানি পৃথিবীর রাষ্ট্রশক্তি গুলি কখনই তা দাঁড়াবে না, যদি না জনমতের চাপ প্রবলভাবে তাদের ওপর পড়ে। কেননা, মানুষের মৃতদেহ নিয়ে এরা কূটনৈতিক দাবার চাল খেলতে অভ্যস্ত। আমরা এখন দেখতে চাই, দেশে ফিরে গিয়ে এই দুই এম. পি বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে কিভাবে জনমতকে সংগঠিত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য বন্ধ করার জন্যে, সর্বোপরি যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে ভারত চলে আসছে তাদের জন্যে ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার জন্যে। তারা বাংলাদেশের প্রকৃত উপকার করবেন।
যাই করা হােক এটা যেন মনে রাখা হয় যে বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির কোনাে প্রস্তাব চাপিয়ে দেবার আর কোনাে সুযােগ নেই। পচিশে মার্চ রাত বারােটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা নিজের হাতে সে সুযােগকে গুলীতে ধ্বংস করেছেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সামনে ফেরবার আর কোনাে পথ খােলা নেই। কোনাে আপােষ তারা আর মানতে পারে না। এই অবস্থাকে আগ্রহী করে যদি কোনাে সমাধানের কথা ভাবা হয়, তাহলে সেটা কখনই বাস্তব, সুতরাং স্বার্থক হবে না। এরই আলােকে নিজেদের কর্তব্য স্থির করতে হবে, মি: ডগলাসম্যান ও মি: ইয়ং যেন তাদের সরকারকে সে কথাটা বােঝাতে সচেষ্ট হন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১