You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়া খা শুনলে খুশী হবেন

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একই সময়ে রাজ্য গুলিকে অধিকতর ক্ষমতা দেওয়ার কয়েকটি দাবী শােনা গেছে। তামিলনাড় থেকে মুখ্যমন্ত্ৰী শ্ৰীকরুণানিধি বলেছেন যে, রাজ্যের স্বায়ত্বশাসনের দাবী যদি উপেক্ষিত হয় তবে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠবে। কেরল থেকে শ্ৰীই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ বলেছেন, পূর্ববঙ্গের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভারত সরকার যদি রাজ্যগুলিকে অধিকতর স্বায়ত্বশাসনের অধিকার না দেন তাহলে ভারতবর্ষে বাংলাদেশের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পাঞ্জাব থেকে অকালী দলের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ জগজিৎ সিং শ্রীনামুদ্রিপাদের কথায় সায় দিয়ে আরও এক কাঠি এগিয়ে গেছেন। তিনি দাবী করেছেন, দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, যােগাযােগ ও মুদ্রা, মাত্রএই কয়টি বিষয় কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত রেখে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে একটি শিথিল কনফেডারেশনে পরিণত করা হােক। আজকের পরিস্থিতিতে এই ধরনের কথা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ঘটনার সঙ্গে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ রাজ্যগুলির দাবীর তুলনা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাকে খুশী করবে। ডাঃ জগজিৎ সিংকে প্রকরান্তরে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁর দলভুক্ত মন্ত্রী শ্ৰীত্রিলােচন সিং রিয়াস্তি। নিজের দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের বিরােধিতা করে শ্ৰীরিয়াস্তি বলেছেন, “কোন কোন রাজনৈতিক নেতা দাবী মেনে না নেওয়া হলে ভারতবর্ষে বাংলাদেশের অনুরূপ পরিস্থিতি দেখা দেবে। এটা দুঃখের বিষয় যে, এই রাজনৈতিক নেতারা তাদের নিজেদের যুক্তি দিতে গিয়ে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রের জাতি নাশের ঘটনাটিকে কাজে লাগাচ্ছেন বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা আজ সাহায্য ও সমর্থনের জন্য ভারতবর্ষের দিকেই সবচেয়ে বেশী করে তাকিয়ে আছেন। এই সময়ে যারা দেখাতে চাইছেন যে, পাকিস্তানের মতাে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও অনিচ্ছুক অঙ্গরাজ্যগুলির উপর নিজেদের কতৃত্ব জোর করিয়ে চাপিয়ে রেখেছেন তারা কাদের মনােবল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছেন? বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের? না, পিন্ডির শাসকদের? অথচ, একটু চিন্তা করলেই বােঝা যায় যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির কোন তুলনাই হয় না। পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানের অধিবাসীদের সংখ্যাগুরু অংশ বাস করে এবং এই সংখ্যাগুরু অধিবাসীদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের ঔপনিবেশিক শােষণ ও শাসন চালান হচ্ছিল সেই দেশের ডিকটেটরের হুকুমে। আর ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় নির্বাচিত গণপরিষদের দ্বারা রচিত সংবিধানের সাহায্যে। তার মানে অবশ্য এমন নয় যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামাের মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার প্রয়ােজন নেই। শুধু শ্রীকরুণানিধির মতাে অকংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীরাই নন, শ্রীব্রহ্মানন্দ রেডডি ও শ্ৰীঅচ্যুত মেননের মতাে কংগ্রেসী বা কংগ্রেস-সমর্থিত মুখ্যমন্ত্রীরাও রাজ্যগুলির হাতে অধিকতর ক্ষমতা, বিশেষ করে আর্থিক ক্ষমতা, দেওয়ার দাবী জানিয়েছেন। রাজস্ব আদায়ের অধিকতর লাভজনক সূত্রগুলি কেন্দ্রীয় সরকারেরই শর্তাধীন অথমঞ্জুরি দিয়ে রাজ্য সরকারগুলির এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়েও তাদের অধিকার ধূর্ব করেছেন। রাজ্য সরকারগুলি সঙ্গতভাবেই এই ধরনের অভিযােগ করতে পারেন এবং সেগুলির প্রতিকার দাবী করতে পারেন। রাজ্যপালের ভূমিকা, রাজ্য সরকারগুলির অনুমােদন ছাড়া কেন্দ্রীয় পুলিশ পাঠান ইত্যাদি কতকগুলি বিষয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গত বক্তব্য থাকতে পারে। এইসব বক্তব্য বিবেচনা করার জন্য আলাপ-আলােচনা করা যেতে পারে (কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীমােহন কুমারমঙ্গলম যেমন বলেছেন), সংবিধানের ২৬৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি একটি আন্তঃরাজ্য পরিষদ গঠন করতে পারেন, অথবা সংবিধান সংশােধন করা হতে পারে। তামিলনাড়ু সরকার কর্তৃক গঠিত রাজামান্নার কমিটি এই বিষয়ে হয়তাে কিছু পথের নির্দেশ দিতে পারবেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বিচ্ছিন্নতার হুমকি দেওয়া অথবা ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বাংলাদেশ ঘাটবর কথা বলা আজকের পরিস্থিতিতে অতিশয় বাড়াবাড়ি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!