বাস্তবের মুখােমুখী নয়াদিল্লী
মহাফ্যাসাদে পড়েছেন পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। বাঙলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন তাদের রাজ্যে। আরও আসবেন। শেষ পর্যন্ত এদের সংখ্যা কতর কোঠায় পৌছবে, জানা নেই কারও। পশ্চিম বাংলার উপর চাপ পড়েছে সবচেয়ে বেশী। ইতিমধ্যেই এখানে প্রায় বিশ লক্ষ শরণার্থী এসে গেছেন। রাজ্যের কাঠামাে ক্রমেই নুয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিচ্ছে নানারকমের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জটিলতা। গত দেড় মাস ধরে কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করা হচ্ছিল। তাদের টনক নড়ে নি। নয়াদিল্লীর গতানুগতিক গদাই লস্করী চালে চ্ছেদ পড়ে নি। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন শরণার্থীদের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে রাখা হবে। অবস্থা অনুকূল হলেই তারা বাঙলাদেশে ফিরে যাবেন। গত সাতই মে শ্রীমতী গান্ধী ঘােষণা করলেন বাঙলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন এখনও বিবেচনাধীন। কেন্দ্রীয় সরকার আপাততঃ যদ্ভবিষ্য নীতি অনুসরণ করে চলবেন। বাঙলাদেশের লড়াই তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। নূতন নূতন শরণার্থী তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন। যে নীতি নয়াদিল্লী নিয়েছেন তার পরিণতির কথা হয়ত প্রশাসকদের মাথায় আসে নি। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বিহার এবং পশ্চিম বাংলা প্রমাদ গণছে। মুখ্যমন্ত্রীরা একযােগে হাজির হয়েছেন দিল্লীতে। পশ্চিম বাংলা স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে, এত শরণার্থীর বােঝা বহনের ক্ষমতা তার নেই। অন্যান্য রাজ্যকে অংশীদার হতে হবে সর্বভারতীয় সমস্যার মােকাবিলায়। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি অপর রাজ্যগুলাের সঙ্গে কথা বলবেন। পশ্চিম বাংলার ভার লাঘব করবেন। কথাটি আগেভাগেই বলে রাখলে দোষ কি হত? পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সম্ভাবনা তাে কারও অজানা ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শদাতারা এতদিন কি করছিলেন? শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে দিবা নিদ্রায় ব্যস্ত ছিলেন? স্বাধীনতার পর থেকেই একটির পর একটি সমস্যা দানা বেধে উঠছে। শক্ত জট না পাকানাে পর্যন্ত কখনই। নয়াদিল্লীর মােহ ভাঙ্গে না। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন শরণার্থীরা সীমান্তের কাছাকাছি থাকবেন। এখন আবার বলছেন—তাদের অন্যান্য রাজ্যে পাঠাবার চেষ্টা করবেন।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় মত পাল্টানাে পরিচ্ছন্ন প্রশাসনের এবং দূরদৃষ্টির লক্ষণ নয়। একথা অনস্বীকার্য যে, বাঙলাদেশের লড়াই দীর্ঘদিন চলবে। মুক্তিযােদ্ধাদের অনুকূলে এ যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হলে যেসব ব্যবস্থা বৃহৎ শক্তিগুলাের নেওয়া উচিত ছিল তা তারা নেয় নি। ভারতও এককভাবে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ভরসা পায় নি। শেষ পর্যন্ত শরণার্থীদের অনেকেই হয়ত যেতে চাইবেন না স্বদেশে আর অনেকের ফিরতে বেশ সময় লাগবে। সুতরাং অনির্দিষ্টকালের জন্য লক্ষ শরণার্থীর বােঝা বইতে হবে ভারতকে। আন্তর্জাতিক সাহায্য কিছুটা ভার লাঘব করবে। কিন্তু এতগুলাে মানুষের অবস্থানের ফলে যে সব রাজনৈতিক এবং সামাজিক সঙ্কট দেখা দেবে তার জের আটকাতে পারবে না কেউ। গণহত্যা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা বাংলাদেশকে বাঙালী শূন্য করা ইয়াহিয়ার মস্ত বড় চাল। এই চালের ফসল তিনি তুলছেন। মাঝখান থেকে হিমশিম খাচ্ছেন নয়াদিল্লী। তারা ইসলামাবাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। বেশী বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে দেউলিয়া হচ্ছে পাকিস্তান এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতকেও তিনি করছেন অস্থিচর্মসার। মুক্তিফৌজের চূড়ান্ত বিজয় ছাড়া বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে না। তা না এলে অধিকাংশ শরণার্থী ফিরে আসবে না। নয়াদিল্লী তাদের তাড়িয়ে দিতেও পারবেন না। কোন সভ্য রাষ্ট্র তা পারেন না। পশ্চিম দুনিয়া এবং আমেরিকা হয়ত ভাবছে, বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা কনফেডারেশন সৃষ্টি করা যাবে। আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবীর মধ্যেই ছিল এই কনফেডারেশনের ইঙ্গিত। জনতার রায়ও ছিল তার অনুকূলে। ইয়াহিয়া খান ভেঙ্গে দিয়েছেন এই সম্ভাবনা। অস্ত্রের জোরে এবং রক্তস্রোতের মধ্যে তিনি কায়েম করতে চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক শাসন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব। গত পচিশে মার্চ যে সূত্র ছিড়ে গেছে তা জোড়া লাগান কষ্টসাধ্য। ভারতীয় সংসদ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে দিয়েছেন আশীর্বাদ। তার সার্থক পরিণতি সম্পর্কে জানিয়েছেন সর্বসম্মত আস্থা। এই আস্থাকে ফলপ্রসু করার আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ ভারতের নৈতিক কর্তব্য। তা না হলে মুক্তিযােদ্ধারা পারেন না মনের জোর। শরণার্থীদের মধ্যে আসবে না দেশে ফিরার তাগিদ। ইয়াহিয়ার ফাঁদ থেকে নয়াদিল্লীও বেরিয়ে আসবে পারবেন।
এই বাঞ্ছিত পথ যখন বিলম্বিত তখন শরণার্থী সম্পর্কে বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণই যুক্তিযুক্ত। যদ্ভবিষ্য নীতি কোন সমাধানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। তাতে জটিলতা বাড়বে। পশ্চিম বাংলা এবং তার পার্শ্ববর্তী সীমান্ত রাজ্যগুলাের ঘাড়ে সর্বভারতীয় সমস্যা চাপিয়ে নয়াদিল্লীর আন্তর্জাতিক রাজনীতির কসরতের দিন আর নেই। একথা স্পষ্টাস্পষ্টি কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিয়ে ভালই করেছেন রাজ্য সরকার। তা না হলে নয়াদিল্লীর তন্দ্রা টুটত না। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটত না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ মে ১৯৭১