You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থী আগমন অব্যাহত: সমস্যা বাড়ছে

হলদিবাড়ী শহরে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শরণার্থী আসতে থাকায় এক গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোচবিহার জেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানিয়ে বলেছেন, দৈনিক গড়ে বারাে হাজার মানুষ হলদিবাড়ী আসছেন। জেলা কর্তৃপক্ষ আরাে বলেছেন, শহর ও সীমান্ত পরিদর্শন করে দেখা গিয়েছে বুধবার প্রায় বারাে হাজার শরণার্থী এসেছেন এবং সীমান্তের ওপারে আরাে বাইশ হাজার মানুষ এপারে আসার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
কোচবিহার জেলার ছােটো শহর হলদিবাড়ীতে এ পর্যন্ত দেড় লক্ষেরও বেশী শরণার্থী এসেছেন। বিভিন্ন। বিদ্যালয় ভবন কিংবা খালি বাড়ীতে প্রথম দিকে এদের স্থান দেওয়া হয়েছিল, এখন তাও পাওয়া যাচ্ছে না। বহু শরণার্থীকে আকাশের তলায় রাত কাটাতে হচ্ছে। এই অসহনীয় অবস্থার প্রতীকারের জন্যে জেলা। কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের কাছে তাঁবু এবং ওষুধপত্র চেয়েছেন।
কোচবিহারে সােয়া লক্ষ শরণার্থী কোচবিহার থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি হরিপদ মুখার্জি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা প্রতিদিনই কোচবিহার জেলাতে যথেষ্ট সংখ্যায় আসছে। এ পর্যন্ত কোচবিহার জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে সওয়া লক্ষ শরণার্থী এই জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। এই জেলার কয়েকটি শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখলাম, এখনও অনেক সরকারি আয়ে শিবির দরকার।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইতিমধ্যে ৩৫টি শিবির প্রায় পঞ্চাশ হাজার শরণার্থীকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলের স্কুলবাড়ীগুলােই অস্থায়ী শিবিরে পরিণত হয়েছে, তৎসত্ত্বেও আরও বহু মানুষ রাস্তার পার্শ্বে অথবা খােলা মাঠে নিজেদের সতরঞ্জি, চাদর দিয়ে ছাউনী করে কোনােমতে মাথা গুজবার ঠাই করে নিয়েছে। সরকারি শিবিরে নাম উঠেনি বলে তাদের বাইরের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলাের খয়রাতী সাহায্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। কোচবিহার জেলার হলদীবাড়ী ও দিনহাটা সীমান্ত। দিয়েই বেশী পরিবার আসছে।
শরণার্থীরা যারা এ পারের আশ্রয় শিবিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মধ্যে এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোন পার্থক্য নেই—এক পরিচয় ওরা সবাই বাঙ্গালী। পাশাপাশি একই শিবিরে দুই সম্প্রদষয়ের লােক একত্রে রান্নাবাড়া করে খাচ্ছে। খোঁজ-খবর নিচ্ছে। ওপারের আত্মীয়স্বজনের খবর বিনিময় করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করছে, ওদের প্রত্যাহিক খবর নেবার জন্য ওরা ব্যাগ্র কবে ঘরে ফিরে যাবে তারই প্রতীক্ষা করছে। তাই এই বাংলার আতিথেয়তায় তারা মুগ্ধ, সামান্য ত্রুটীগুলি তাঁরা ধরছেন না।
শিলিগুড়িতে নিজস্ব প্রতিনিধি লিখছেন: আট বছরের তয়েব বাবা-মাকে হারিয়ে আজ ইসলামপুর স্কুল ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। পাক দস্যুরা গুলীতে তার বাবা ও মাকে হত্যা করেছে। তয়েবের বাবা রফিক ঠাকুরগাঁ শহরে রিকশা চালাতাে। সম্প্রতি পাক সৈন্য ঠাকুরগাঁ শহরে প্রবেশ করে এবং সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই নির্বিচারে গুলী করে হত্যা করে।
পাক সৈন্য আসার পূর্বে বেশীর ভাগ লােক শহর ছেড়ে চলে যায়। যারা নিঃস্ব, দরিদ্র একমাত্র তারাই শহরে ছিল। মনে করেছিল পাক সৈন্য তাদের কিছু ক্ষতি করবে না। কিন্তু বর্বর পাক সৈন্যের নিকট ধনী-দরিদ্রের বিচার নেই।
রফিককে গুলী করে বর্বররা তয়েবের মার দিকে বন্দুক তাক করে। তাই দেখে তয়েব কেঁদে ওঠে এবং সঙ্গে। সঙ্গে বন্দুকের গুলীতে তার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই দেখে তয়েব দৌড়িয়ে নদীর ঘাটের দিকে পালায়। সেখানে অনেক লোেক নদী পার হয়ে ভারত সীমান্তের দিকে পালাচ্ছে। তয়েব তাদের সঙ্গে ভিড়ে পড়ে। তার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা সকলকে স্পর্শ করে। তারা তয়েবকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ নানা গ্রাম ঘুরে ইসলামপুরে আসেন এবং জয় বাংলা সংগ্রাম সংহতি কমিটি পরিচালিত ক্যাম্পে আশ্রয় পান।
ছেলেরা তয়েবের নাম দিয়েছেন মন্টু। মন্টুর হৃদয়বিদারক কাহিনী এখন ক্যাম্পের সকলের মুখে। মন্টুও ক্যাম্পবাসী ও কর্মীদের বড় প্রিয়, বড় আপনজন হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে ইসলামপুর মহকুমায় দেড় লক্ষের উপর উদ্বাস্তুর আগমন হয়েছে। জয় বাংলা সংগ্রাম সংহতি কমিটি অনেক উদ্বাস্তু বিনামূল্যে রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করছেন।
এই ক্যাম্পের বেশীর ভাগ লােক এসেছেন বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁ অঞ্চল থেকে। এদের নিকট পাক বাহিনীর বহু অকথ্য অত্যাচারের ঘটনা জানা গেল। গত ৩০শে এপ্রিল ঠাকুরগাঁর রুহিয়া গ্রামে পাক বাহিনীর
দা জামা-কাপড়ে প্রবেশ করে ৫ জনকে গুলী করে মেরে ফেলে। ঠাকুরগার ওয়াপদা কলােনীর নিকট ইস্ট পাকিস্তান ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট সংস্থার প্রায় ৬০ জন কর্মীকে পাক বাহিনী ট্রাকে করে কাজে যােগ দিতে নিয়ে যায়। কিন্তু তারপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। যুবতী মেয়েদের গ্রাম থেকে রাতে জোর করে নিয়ে যাওয়া তাদের কয়েকজনকে ভােরে ছেড়ে দেওয়া এবং বাকী অংশের কোন খোঁজ না পাওয়া প্রায় নিত্যকার ঘটনা বলে উদ্বাস্তুরা জানান। ঠাকুরগাঁ শহরের সমস্ত দোকানপাট এবং বাড়ী-ঘর লুঠ করে জিনিসপত্তর সৈয়দপুরে নিয়ে গিয়েছে এ ব্যাপারে মুসলিম লীগ ও জমিয়েৎ-ই ইসলামের সদস্যরাই বেশী অগ্রণী। বর্তমানে এরাই পাক বাহিনীর হয়ে পঞ্চমবাহিনীর কাজ করছে বলে উদ্বাস্তু বললেন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার লক্ষ উদ্বাস্তু সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরায় এসে হাজির হয়েছে। ত্রিপুরার নিজস্ব লােকসংখ্যা হলাে ১৫ লক্ষ। সাব্রুম মহকুমায় এসেছে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার উদ্বাস্তু। এই মহকুমার নিজস্ব লােকসংখ্যা হলাে মাত্র ৬০ হাজার। সরকারি সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে। একটি বিবৃতিতে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীশচীন্দ্রলাল সিংহ ত্রিপুরায় আগত উদ্বাস্তুদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, উদ্বাস্তুদের জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাওয়া যায় নি। করিমগঞ্জ থেকে প্রাপ্ত রিপাের্টে প্রকাশ পায় ৫০ হাজার উদ্বাস্তু গত এক মাসে সীমান্ত পেরিয়ে করিমগঞ্জে এসে হাজির হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ হাজার উদ্বাস্তুকে করিমগঞ্জ মহকুমার মােট ২৭টি শিবিরে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয় হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার উদ্বাস্তু করিমগঞ্জ সীমান্তে এসে হাজির হচ্ছে। করিমগঞ্জে বাংলাদেশ ত্রান কমিটির পক্ষ থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে বলা হয়েছে যে, সীমান্তের ওপার থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে উপযুক্ত খোঁজখবর করার পর ভারতে বসবাসের অধিকার যেন দেওয়া হয়। অন্যথা সমাজবিরােধীরা এই সুযােগে ভারতে এসে হাজির হতে পারে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!