You dont have javascript enabled! Please enable it!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন মােটেই দীর্ঘ নয়। সব মিলিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন প্রায় আঠাশ বছরের। এর ভিতর মাত্র ২০ বছর তিনি সময় নিয়েছিলেন তাঁর জাতিকে একটি স্বাধীনতার সংগ্রামের মুখােমুখি দাঁড় করাতে। সে সংগ্রামে তিনি তাদেরকে বিজয়ী করেছিলেন। এত কম সময়ে খুব কম নেতাই তার দেশকে মুক্তি ৰা স্বাধীনতা দিতে পেরেছেন। এদিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির সফলতম নেতা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতাদের তালিকা করতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর দুজন নেতার নাম আসে। এই দুজন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে জনগণের দেয়া পদবিতে ভূষিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন জনগণ বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করেছিলেন, ওই দুজনকেও জনগণ অমনি পদৰি দিয়েছিলেন। এদের একজন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অপরজন নেতাজি সুভাষ বসু। এ দুজনের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে শ্রদ্ধা ছিল তাতে তাঁর জীবদ্দশায় এদের সারিতে বঙ্গবন্ধুকে দাঁড় করালে তিনি কুষ্ঠিত হতেন। কিন্তু ইতিহাস সফলতায় এঁদের সারিতে শুধু নয়, সফলতম নেতা হিসেবে বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতায় পরিণত করেছে শেখ মুজিবকে।
 
চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ বসু দুজনই বাঙালি ছিলেন। কিন্তু এরা কেউই শুধু বাঙালির নেতা ছিলেন না। দুজনই ছিলেন ভারতবর্ষের নেতা। তাঁদের রাজনীতির ক্ষেত্র ছিল সমগ্র ভারতবর্ষ। তারা ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। সেটা ছিল ওই প্রজন্মের দাৰি। শেখ মুজিবুর রহমান ওই প্রজন্মের নন, যদিও তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। তবে তিনি যখন তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এই সময়ে চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেছেন, সুভাষ বসুও নিরুদ্দেশ হয়েছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক ধারা তখন ভারতের রাজনীতি থেকে গত হয়েছে। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ঢেউ ভারতসাগর তীরে আছড়ে পড়লেও সেটা তরঙ্গ তুলতে পারছে না ওইভাবে। কারণ ততদিনে সুভাষ নিরুদ্দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন বিজয় ঘটেছে। তাছাড়া ভারতের রাজনীতিতে তখন মানুষের তুলনায়, জাতির তুলনায় ধর্ম সামনে এসে গেছে। অধিকাংশই তখন ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ধর্মের মিথ্যে স্রোতের তােড়ে তারা ভেসে চলেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ কোনােরকমে ধর্ম থেকে আপস করে নিজেকে বাঁচানাের চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করছেন দেশ ও মানবসম্প্রদায়কে বাচানাের। এই সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষের রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হন।
 
কেউ কেউ বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময়ে ধর্মীয় রাজনীতির একজন কর্মী। হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে নিউজ উইক শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রচ্ছদ করতে গিয়ে সেখানে লিখেছিল : পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে শেখও ইটের টুকরাে মুড়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব ঠিকই ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে ইটের টুকরাে ছুড়েছিলেন। কিন্তু তার মানে কখনও। এই নয় যে, ধর্মীয় রাজনীতির যে উন্মাদনা, যে অন্ধত্ব আমরা দেখি, সেটা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রাস করেছিল। কারণ সকলেই জানেন, পাকিস্তান আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান হােসেন ছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একজন বিশ্বস্ত কর্মী। ইতিহাসের এ পর্বে এসে আজ এটা স্বীকৃত যে, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ওই সময়ে যে কজন নেতা ধর্মের উন্মাদনার হাত থেকে ভূখণ্ড ও মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, সােহরাওয়ার্দী তাদের একজন। তাই পাকিস্তানের থেকেও তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল মানুষের জীবন। এ কারণে ধর্মের উন্মাদনায় সৃষ্ট ভারত-পাকিস্তানে অধিকাংশ যখন ক্ষমতা গ্রহণে ব্যস্ত, ওই সময়ে যে ক’জন জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে মানুষকে বাঁচাতে নেমে পড়েছিলেন—হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাদের একজন। অন্যদিকে তার কর্মী শেখ মুজিবুর রহমানকেও দেখা যায় পাকিস্তান নামক ওই ধর্মীয় রাষ্ট্রটির ক্ষমতা গ্রহণকারীদের কারােই ধারেকাছে যাচ্ছেন না। বরং সােহরাওয়ার্দী দূরে থাকলেও তার প্রতি অবিচল আস্থা শেখ মুজিবের। এবং তিনি তখন থেকেই ওই ধর্মীয় রাষ্ট্রের বদলে মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
 
চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ বসুর সঙ্গে এখানেই শেখ মুজিবুর রহমানের মিল। এখানে এসেই বলা যায় তিনি এ উপমহাদেশে ওই ধারার রাজনীতির সফলতম পুরুষ। চিত্তরঞ্জন দশ-এর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন সুভাষ বসু। দুজনেই একই ধারার রাজনীতি করেছেন। এ দুজনই চেয়েছিলেন গান্ধী, জিন্নাহ প্রমুখের ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতি থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে অর্থাৎ গােটা ভারতবর্ষকে মুক্ত করে একটি মানুষের ভারতবর্ষ তৈরি করতে। সেই স্বাধীন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করতে। চিত্তরঞ্জনের সংক্ষিপ্ত জীবন দুর্বল স্বাস্থ্য তাকে এ কাজ থেকে ব্যর্থ করেছিল। অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতির সন্তান সুভাষ বসু হেরে গিয়েছিলেন এ-কাজে বিশ্বরাজনীতির পটপরিবর্তনের কারণে। শেখ মুজিবুর রহমান এ দুজনের রাজনৈতিক জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন কিনা সেটা তিনি কোথাও লিখে রেখে যাননি। তবে তিনি বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে এ দুই রাজনীতিকের প্রতি বা নেতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধার কথা জানিয়েছেন। তাই আজ মনে করলে ভুল হবে না নেতাজি। 
 
তার জাতিকে ধর্মের অন্ধত্ব ও সামরিক শাসনের বর্বরত্ব থেকে মুক্ত করতে হয় তাহলে ঝড়ের বেগে রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রস্তুত করতে হবে আরও বেগে মানুষকে। নইলে একজীবনে একটি জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারে পৌছানাে যাবে না। যেমন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর মতাে আরেক নেতা ইয়াসির আরাফাত পারেননি তার জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারে পৌছে দিয়ে যেতে। তার আগেই তিনি সন্তানের কাধে পিতার মৃতদেহ হয়েছেন। তাকে শুধু তার জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এ ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়নি। মেনে নিতে হয়েছে বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের কারণেও। দেশবন্ধু ও নেতাজির জীবন মেলালেও এই দুই পাওয়া যায়। দেশবন্ধু পারেননি তার সংক্ষিপ্ত জীবনের কারণে। আর নেতাজি পারেননি বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের কারণে। শেখ মুজিবুর রহমান হয়তাে এই সংক্ষিপ্ত জীবন আর বিশ্বরাজনীতির দুত পটপরিবর্তন মাথায় রেখেছিলেন শুরু থেকে। তাই দেখা যায় তার রাজনীতির গতি বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে যে দুরন্ত গতির গাের্কি আঘাত হেনে উপকূল বিধস্ত করে দেয় তার থেকেও গতিশীল।
 
লন্ডন টাইম ‘৭১ সালে লিখেছিল ঃ শেখ মুজিব মাত্র ২০ বছর তাঁর জাতিকে প্রস্তুত করে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন হিসেব করলে সেটাই মনে হয়। এখানে শেখ মুজিবকে দুটি পর্বে কাজ করতে হয়েছে। এখন প্রচণ্ড ধর্মীয় উন্মাদনায় ভেসে আসা একটি জাতিকে তার আত্মপরিচয়ে ফেরত আনতে হয়েছে। জাতি হিসেবে সে যে বাম্ভালি এটা তাকে বােঝাতে হয়েছে। এ কৃতিত্ব শেখ মুজিবের অবশ্য একক নয়। পাকিস্তানি উন্মাদনা থেকে বাঙালিকে বাঙালি হতে ওই সময়ে বাঙালির শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সকলেই কাজ করেছিল। তবে এটা সত্য যে, ওই সময়ে এ রাজনীতির শক্ত ধারক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীদের ভাষা যেখানে পৌছে না, ওই সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক ভাষায় বাঙালিত্বকে হাজির করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সহজে সাধারণ কথায় ও আচরণের ভিতর দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভিতর অল্পকিছু দুরাচারসহ সকলকেই বাঙালিতে পরিণত করেছিলেন। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের আরও বড় কৃতিত্ব হল তিনি তার নেতৃত্বকালে তরুণসমাজের সবথেকে বড় আকর্ষণ ছিলেন। অন্য কোনাে নেই তাঁর সমান জনপ্রিয় ছিল না তরুণদের কাছে। দেশের ওই তরুণ সম্প্রদায়ের কাছেই তিনি বাঙালিত্ব এবং “দেশ আমার এই দুই আদর্শকে বড় করে তুলতে পেরেছিলেন। দেশের তরুণসম্প্রদায় মনেপ্রাণে সেটা গ্রহণ করেছিল। এ কারণে দেখা যায় যাটের দশকে এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি হয়ে যায় হাতেগােনা আর বাঙালি তখন প্রায় সকলে, যতটা বাঙালি আমরা এখন সকলে। মই।
 
শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিবিদ। দেশের মানুষের মনের খবরটি তাঁর আগে অন্য কেউ জানতে পারত না। তাই ষাটের দশকে এসে তিনিই সঠিক উপলব্ধি করেন, লােহা তপ্ত হয়েছে ঠিক ঠিক। অর্থাৎ আঘাত করার সময় বয়ে যায়। তাই ‘৬৬ সালে 
 
তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ আন্দোলনকে একটি ফ্রেমওয়ার্কের ভিতর এনে স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন কর্মসূচি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয়দফা ঘােষণা করেন। তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে ছয়দফা ঘােষণার পর আর রাজনীতির কোনাে উপায় থাকবে না হেঁটে চলা। তখন রাজনীতিকে আপন গতিবেগেই ঝড়ােগতিতে চলতে হবে। শেখ মুজিবের ধারণা সঠিকই হয়। ছয়দফা ঘােষণা করার পরে পাকিস্তানের রাজনীতিকে আরা কোনােকিছুর ভিতর বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি তখন বাত্তালির প্রতিপক্ষ আইয়ুব খান সরাসরি বলতে বাধ্য হয়, পাকিস্তানের কাঠামাের ভিতর বসে ছয়দফা মেনে নেবার কোনাে উপায় নেই। তাই তিনি অস্ত্রের মাধ্যমে ছয়দফার জবাব দিতে নামেন। আর রাজনীতির বিরুদ্ধে যখনই অস্ত্র নিয়ে, রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে নামা হয় তখনই শক্তিশালী হয় রাজনীতি। জয়ী হন রাজনীতিবিদ। তাই রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে অস্ত্রের ভাষায় ছয়দফাকে যতই জবাব দেবার চেষ্টা চলে ততই শেখ মুজিবুর রহমান চলে যান বাংলার মানুষের মণিকোঠায়। দেখা যায় মাত্র তিন বছর না-যেতেই শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হন। অর্থাৎ একজন শেখ মুজিবুর রহমান তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকৃতি লাভ করেন।
 
মানুষের এই মূর্তি হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মানুষের শক্তিকে ভুলে যাননি। অন্য অনেক রাজনীতিক নির্বাচনে বিরােধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে থাকেন আপসহীন। এমনকি মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করে তিনি স্বৈরাচারের ফ্রেমওয়ার্কের ভিতরই নির্বাচনে যান। কিন্তু নির্বাচনের রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ওই ফ্রেম টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। শেখ মুজিব তখন মানুষের নির্বাচিত নেতা। তাকে ও তার মানুষের দাবিকে অস্বীকার করে এ সাধ্য তখন আর কার? অর্থাৎ তিনি তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে যেখানে পৌছে গেলে ওই রাক্ষসের প্রাণভােমরা মারা পড়ে যায়। রাজকন্যা উদ্ধার হয়। বাঙালি তখন শেখ মুজিবের হাত ধরে সেখানেই পৌছে গেছে। আর এখানে পৌছাতে রাজনীতির এ-পর্বে শেখ মুজিব সময় নিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ বছর। এ-কারণে একটি জীবনের আর বিশ্বরাজনীতির বড় কোনাে মােড় নেয়ার আগেই শেখ মুজিব পেীছে যেতে পেরেছিলেন তার কাঙ্কিত লক্ষ্যে। | শেখ মুজিবের এই জীবন ও রাজনীতির গতির দিকে তাকলে তাই মনে হয় এ যেন সত্যিই ঝড়ের গতি। সত্যিই তিনি ছিলেন এক ঝড়ের গতির রাজনীতিক।
 
জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৭
সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!