একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি কূটনীতি
ইকবাল আখুন্দ
১৯৭১ সালে ইকবাল আখুন্দ সাবেক যুগােস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। ইকবাল আহমেদ আখুন্দ ২১ আগস্ট ১৯২৪ সালে ভারতের হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে কূটনীতিক হিসেবে পাকিস্তান সরকারে যােগ দেন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রজন্মের কূটনীতিকদের অন্যতম। তাঁর বই মেমােয়ার্স অব আ বাইস্ট্যান্ডার: আ লাইফ ইন ডিপ্লোম্যাসি (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭) থেকে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ-সম্পর্কিত নির্বাচিত অংশের অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলাে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। কায়রাে দূতাবাস থেকে ছুটি নিয়ে করাচিতে গিয়ে বেলগ্রেডে বদলির আদেশ পেলাম। যেদিন ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের বিরুদ্ধে সৈন্য নামালেন, সেদিন সন্ধ্যাবেলা ইয়ার-দোস্তরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল কাওয়ালির আসরে। কোর্তা-পাজামায় ধােপদুরস্ত ঝানু সমঝদারেরা মেঝেতে মােটা বালিশে আয়েশে হেলান দিয়ে পান চিবুচ্ছেন আর মারহাবা ধ্বনিতে গায়কদের দিকে ব্যাংকনােট বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটে চলেছে, তা দেশের জন্য কী বয়ে আনবে, সে ব্যাপারে কারও মুখে টু শব্দটি নেই। এই হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্ট, শাসক ও প্রশাসক চক্র। কেউ কেউ বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন, তবে অনেকেই সম্ভবত ভেবেছিলেন শেখ মুজিবের বেলায় যা ঘটার, তা-ই ঘটেছে। ওই আসরে সংকট নিয়ে, অনিবার্য বিপর্যয় নিয়ে কারও চেহারায় কোনাে ভাবান্তর নেই। ঢাকার মানুষের জন্য কোনাে উদ্বেগ ঝরল না কারও কণ্ঠে।
ঢাকা থেকে ফিরে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘােষণা করলেন, এ যাত্রায় পাকিস্তানের ফাড়া কেটে গেছে! অবশ্য পরদিন সকালে আমি যখন তার
পৃষ্ঠা: ১০৪
করাচির বাড়িতে ফোন করলাম, কণ্ঠ শুনে তাঁকে কিছুটা হতােদ্যম মনে হলাে। জানতে চাইলাম, যেহেতু আওয়ামী লীগকেই শুধু দেশদ্রোহের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খান সব কটি রাজনৈতিক দলকে কেন নিষিদ্ধ করলেন। তিনি বললেন, এটা নিছক লােকদেখানাে ব্যাপার। শিগগিরই আরও নতুন ঘটনা ঘটতে দেখবে তুমি। তিনি কী ঘটুক চাইছিলেন, তা স্পষ্ট হলাে। বােধ করি মিলিটারি তাকে এটা বিশ্বাস করিয়েছে। যে তারা একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে তাকে একটা মজবুত অবস্থান গড়তে দেবে, রাজনৈতিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করতে দেবে। অচিরেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেল, আর যা-ই হােক, এমন চিন্তা ওদের মাথায় ঘুণাক্ষরেও নেই। এ সত্ত্বেও ভুট্টো অবিচল থাকলেন। যখন কয়েকটা মাস কেটে গেল, তখনই কেবল ভুট্টো ভয়াল সেই রাতের বিরুদ্ধে সােচ্চার হলেন আর পূর্ব পাকিস্তানে শাসক চক্রের কর্মকাণ্ডকে ধিক্কার জানালেন।
২৩ মার্চে [আসলে তারিখটা হবে ২৫ মার্চ] সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার পর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টা ছিল এবং আজও তা হয়ে আছে এক দুঃস্বপ্ন, বিভ্রান্তি ও অন্ধকারের কাল। যে বর্বরতা চালানাে হয়েছিল, তাতে মসিলিপ্ত হয়েছে ওই সময়টা। কারােরই জানা ছিল না আসলে সত্যটা কী এবং কী ঘটে চলেছে সেখানে। প্রাথমিক বিভীষিকার বিষয়ে কাটছাঁট করা টুকরােটাকরা কিছু খবরাখবর ফাঁকফোকর গলে আমাদের কাছ বরাবর পৌছালেও পরে তার পথও বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে বাস্তবতাকে আড়াল করা হলাে পাকিস্তানি সেন্সরশিপের খাঁড়া দিয়ে এবং সব বিদেশি সংবাদদাতাকে বহিষ্কারের মাধ্যমে। অপর দিকে সবকিছুকে অতিরঞ্জিত করে এবং বানােয়াট গল্প ফেঁদে। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র যেসব কাহিনি প্রচার করত, যাতে মনে হতাে সবকিছুই দিব্যি স্বাভাবিক আছে, কোথাও কোনাে অস্বাভাবিকতা নেই। গ্রামের গােয়ালা তার দৈনন্দিন কাজকর্মে মগ্ন, জীবন বয়ে চলেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। বাইরের দুনিয়া পরিস্থিতির খবর জানত কলকাতা থেকে পাওয়া পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের দেওয়া বর্ণনা ও ভারতীয় প্রপাগান্ডার বদৌলতে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত কাগজগুলােও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত ‘দুবৃর্ত’ এবং ভারতীয় চরদের ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের উল্লেখ না করে পারেনি। আর এ সত্যটাও অস্বীকার করার জো নেই যে, যতই দিন যাচ্ছিল, বাঙালিরা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য তত বেশি সংখ্যায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছিল।
প্রকৃত সত্য এবং কলকাতার বানানাে গালগল্প’ দুনিয়াজোড়া প্রচারমাধ্যমে ফলাও হতে শুরু করায় অচিরেই পাকিস্তানের মাথার ওপর চারদিক থেকে
পৃষ্ঠা: ১০৫
প্রতিবাদ আর ধিক্কার এসে আছড়ে পড়তে লাগল। একসময় তাবৎ মানবাধিকার সংগঠন, পরিবেশবাদী সম্প্রদায়, রক গানের দল, বিটলস গােষ্ঠী এবং হলিউড তারকারা বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি প্রবল একাত্মতা ঘােষণা করল। পাকিস্তানে ওই প্রচারণাকে দেখা হতাে ইসলামি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু-ইহুদি ষড়যন্ত্র হিসেবে। ওই পরিস্থিতিতে ভারতের সংশ্লিষ্টতা ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের দিকটি সবার চোখেই ছিল পরিষ্কার। ইসরায়েলি দরদিরা যে তাতে সহযােগিতার হাত বাড়িয়েছিল, তাতে সন্দেহ কি! ওই ইসরায়েলিরা পাকিস্তানের মধ্যে দেখতে পায় তাদের দুশমনের চেহারা। আর তাই পাকিস্তানকে পরােক্ষভাবে একহাত দেখে নেওয়ার সুযােগ পেয়ে খুশিতে বগল বাজাল তারা।
প্রথম সারির দেশগুলােতে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে জেনেভায় এক বৈঠক বসল পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মােহাম্মদ খান এবং ইয়াহিয়া খানের অন্যতম অন্তরঙ্গ ব্যক্তি ও উপদেষ্টা জেনারেল গােলাম ওমরের (জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান] যৌথ সভাপতিত্বে। ওই বৈঠকের লক্ষ্য ছিল দুনিয়াজোড়া প্রচারমাধ্যমে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি কেন এতটা খারাপ, তা খতিয়ে দেখা। ভৎসনার সুরে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হলাে, এ ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রদূতেরা কী করছেন? অন্যদিকে রাষ্ট্রদূতেরা দাবি জানালেন, পূর্ব পাকিস্তানে আসলে যা ঘটে চলেছে, কোনাে রাখঢাক না করেই তা জানানাে হােক। কেউ কেউ সাহস করে এমন পাল্টা প্রশ্নও করে বসলেন, ‘হ্যা, বাস্তবতার বাইরে কোন ভাবমূর্তিটা প্রকট হবে বলে আপনারা আশা করেন? কিন্তু ইসলামাবাদ আত্মপ্রবঞ্চনায় এতটাই বিভাের ছিল যে সে মাসে ‘প্রেসিডেন্টের জন্য পাঠানাে এক সামারিতে’ ইয়াহিয়া খানকে জানানাে হলাে, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে আমাদের প্রচেষ্টার প্রতি সারা বিশ্বে বিপুল কূটনৈতিক সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আসল সত্যটা হচ্ছে, এরই মধ্যে পাকিস্তান নামটা এতটাই কালিমালিপ্ত হয়ে উঠেছিল যে দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশন থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, এক ডিনার পার্টিতে এক বিদেশি সাংবাদিকের স্ত্রী যখন দেখলেন যে এক পাকিস্তানি প্রথম সচিবের পাশেই তাঁর আসন পড়েছে, তখন তিনি সরে গিয়ে অন্যত্র বসলেন।
এরই মধ্যে যুদ্ধ ঘনিয়ে এল। আর অনেকেই ব্যাপারটি ঠাহর করতে পেরেছিলেন। দিল্লিতে লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি পিটার হাজেলহা তার পত্রিকার ১৩ জুলাই সংখ্যায় এই মর্মে প্রতিবেদন পাঠালেন যে ভারতের সবচেয়ে দায়িত্বশীল মহলটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে। প্রায় একই সময়ে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট অক্টোবর অথবা নভেম্বরেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে তার ক্রমশ
পৃষ্ঠা: ১০৬
ঘনীভূত আশঙ্কার কথা জানালেন জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধিকে। নিরাপত্তা পরিষদকেও তিনি তাঁর উদ্বেগের কথা জানানাের পাশাপাশি তাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরলেন। ওই বছর গ্রীষ্মে মার্শাল টিটো এক রাষ্ট্রীয় সফরে নয়াদিল্লি যান। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে পাকিস্তান সরকারকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাইলেন যে, ‘উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার ব্যাপারে তিনি গভীর সংকটের পূর্বাভাস দেখতে পেয়েছেন।’ অন্যভাবে বললে, তিনি ভারতকে যুদ্ধের জন্য আটঘাট বেঁধে তৈরি হতে দেখেছিলেন। ওই সফর শেষে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে টিটো পাকিস্তানকে [শেখ] মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটি মীমাংসায় পৌঁছার তাগিদ দিয়ে প্রকারান্তরে ভারতের অবস্থানের পক্ষেই সাফাই গাইলেন।
তিনি অবশ্য এটাও জাহির করতে চেয়েছিলেন যে ওই সমস্যার সমাধানে যুদ্ধের পথ বেছে নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাঁর জোরালাে অভিমতও তুলে ধরেছেন। যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে নাক না গলানাের জন্য জাতিসংঘের আহ্বানের পক্ষে যুগােস্লাভিয়া পরে ভােটও দিয়েছিল। ওই সময়টাতে আমি ছিলাম বেলগ্রেডে আর যে কর্মকর্তা আমাকে আগাম তথ্য জানিয়েছিলেন, তিনি বললেন, পাকিস্তান চাইলে টিটো মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত আছেন। আমি মনে করি, প্রস্তাবটা টিটো আন্তরিকভাবেই দিয়েছিলেন। কেননা, তিনি তাঁর নিজের দেশের পরিস্থিতির সঙ্গেও এর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। ভারত একটি সার্বভৌম দেশের। অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানাের নজির স্থাপন করুক, টিটো তা চাননি। যখন আমি আমার পরিচয়পত্র পেশ করি, মার্শাল টিটো জাতিগত ও জাতীয়তাবাদী সংঘাতে দূতিয়ালির প্রসঙ্গ তুলে বললেন, বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে এসবের সমাধানের চেষ্টা করা ভুল ও নিরর্থক। তিনি ঘােষণা করলেন, ‘যুগােস্লাভিয়ায় আমরা চিরকালের জন্য ওসব সমস্যা সমাধান করেছি। পৃথিবীতে আর বলকান সমস্যা বলে কিছু থাকবে না।’
ঘুণাক্ষরেও তিনি ভাবতে পারেননি যে রােমহর্ষ ও নজিরবিহীন রক্তপাত ও বর্বরতার মধ্য দিয়ে একদিন তার দেশের নামটি পর্যন্ত পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই তাঁর নিজ প্রজাতন্ত্র ক্রোয়েশিয়ায় প্রথমবারের মতাে গুরুতর গােলযােগ মাথাচাড়া দিল। আর সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আগে তিনি পাকিস্তানের প্রতি তাঁর বিচক্ষণ পরামর্শের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ওই গােলযােগ দমনে বল প্রয়ােগ করতে মােটে ইতস্তত করলেন না। আমি টিটোর দেওয়া প্রস্তাবের কথা জানিয়ে ইসলামাবাদে তারবার্তা পাঠালাম।
পৃষ্ঠা: ১০৭
পার্সেপােলিশে [ইরানের সিরাজ শহর থেকে ৬০ কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত] ইরানের শাহ পারস্য রাজবংশের দুই হাজার বর্ষপূর্তির বর্ণাঢ্য উদ্যাপনে ব্যস্ত, তখন সেখানে তাঁর (টিটোর) এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে এক বৈঠকের ব্যবস্থা করা হলাে। বৈঠকের সময় টিটোর সঙ্গী এক কর্মকর্তা আমাকে বললেন, বৈঠকটা হয়ে উঠেছিল এক বােবার সংলাপ। টিটো আসল ব্যাপারে ইয়াহিয়ার মুখ থেকে খুব বেশি কথা আদায় করতে পারেননি। আর ইয়াহিয়া পুরােটা সময় তাঁকে (টিটোকে) লম্বা-চওড়া বক্তৃতা শােনালেন ভারতের সম্প্রসারণবাদ, ছলচাতুরী, যুদ্ধংদেহী মনােভাব ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে। যুগােস্লাভরা যে ধারণাটি লাভ করল তা হলাে, ইয়াহিয়া খান আদতেই কোনাে ধরনের রাজনৈতিক মীমাংসা চাচ্ছেন না, চাচ্ছেন কেবল পূর্ব পাকিস্তানে তার কুকর্মকে হালাল করতে। ইয়াহিয়া চক্র বাস্তবিকই সব মহলের সতর্কবাণীকে। কোনাে পাত্তাই দিল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলাে, ওরা বিযুক্ত হয়ে পড়েছে। বাস্তবতা থেকে। ভারত কী করছে না করছে, সে ব্যাপারে গােয়েন্দা মারফত পর্যাপ্ত ও নির্ভুল তথ্য পাচ্ছিল সরকার। ঘনায়মান যুদ্ধের আলামত ঠাহর করতে বেগ পেতে হয়নি সরকারের। তথাপি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যে সর্বনাশের ছবি, শাসকেরা তা দেখেশুনেও নিষ্ক্রিয়তায় বুদ হয়ে রইল। আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পুরােটাই ব্যস্ত থাকল বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে ভারতের ষড়যন্ত্র ও গােপন অভিসন্ধিকে তুলে ধরার চেষ্টায়। জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি [আগা শাহি] তাঁর অবস্থান থেকে যতটা ভালােভাবে সম্ভব দায়িত্ব পালন করলেন। নিজের দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি পরিষদ সদস্যদের ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেখালেন, হিন্দুরা তখনাে কীভাবে মুসলিম বাংলার ধারণাটির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল। হতবাক হওয়া পরিষদ সদস্যরা এ থেকে কী বুঝলেন, তা কেউ জানে না। তবে নিজের দুরভিসন্ধি আড়াল করতে ভারতকে কোনাে বেগই পেতে হয়নি। সােভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন তাে তার ছিলই, আর ওই অবস্থায় এসে সম্ভবত তার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সহৃদয় ঔদাসীন্যও যােগ হলাে। ভারতীয় প্রতিনিধি পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহির অভিযােগের জবাব দেওয়ার মােক্ষম সুযােগটা হাতছাড়া করলেন না। তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানি প্রতিনিধি তার দেশে ভাঙনের কথা বলতে গিয়ে একেবারেই আবেগতাড়িত হয়ে। পড়েছেন। কিন্তু তার দেশের ভাঙনের ষােলােকলা পূর্ণ হয়ে গেছে। দুনিয়ার কারও সাধ্যি নেই একে ঠেকিয়ে রাখে। এখন সেটি ঘটেই গেছে।’
ইন্দো-সােভিয়েত মিত্ৰতা চুক্তিটি সম্পাদিত হওয়ার সময়ই এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল পাকিস্তানের। ওই চুক্তিতে সামরিক বিষয়সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকটা ছিল পরিষ্কার। আর তা হলাে, পূর্ব
পৃষ্ঠা: ১০৮
পাকিস্তানে ভারতের নেওয়া চরম সামরিক পদক্ষেপকে চীন নস্যাৎ করার চেষ্টা করলে তা প্রতিরােধ করা। যুগােস্লাভরা আমার কাছে বাঁকাভাবে বিষয়টি তুলে ধরে বলল, সাহায্য করার ব্যাপারে মিত্রদের ক্ষমতার দৌড় কতটা, তা পাকিস্তান এ যাত্রায় নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। আপাতদৃষ্টে যদিও ব্যাপারটি তেমন ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর। সােভিয়েতরা বিনম্র প্রতিশ্রুতি দিল, পাকিস্তান এই চুক্তির টার্গেট নয়। ওই চুক্তির আসল উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে দফায় দফায় বৈঠকের পরিকল্পনা হলাে। কিন্তু এটা-ওটা কারণে এসব বৈঠক স্থগিত হয়ে যেতে থাকল এবং শেষমেশ দেখা গেল, আদতে কোনাে বৈঠকই হয়নি। চুক্তিটির নিজস্ব ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যা বলল, তাতে আত্মতুষ্টির ভাবটাই ছিল স্পষ্ট, ‘সােভিয়েতরা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কীভাবে মেনে চলছে, এখন কেবল সেটাই দেখার বিষয়। ওয়াশিংটন বা বেইজিংয়ের, কোথাও সােভিয়েত হুমকি মােকাবিলায় কোনাে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হলাে না। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে কৌশল ও কর্মপন্থায় কোনাে পরিবর্তন আনার বিষয়টিও শাসকচক্র একটিবারের মতাে ভেবে দেখল না । বাইরে থেকে আপাত শান্ত-সুনসান ভাব দেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনগড়া ব্যাখ্যাটি দাঁড়াল এ রকম: যুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়ার পক্ষে সােভিয়েতরা সমর্থন দেবে না। প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতির ব্যাপারে সােভিয়েতদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই সাবধানী। এপ্রিল মাসে (নিকোলাই) পদগর্নি এক প্রীতিপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে ইয়াহিয়া খানকে জানালেন: এখনাে তিনি সমগ্র পাকিস্তানের তাবৎ জনগণের কল্যাণ কামনা করেন।
২১ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়া’ বাদ দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে এরই মধ্যে কার্যত বাংলাদেশ বনে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়ল। দুই সপ্তাহ পর নিরাপত্তা পরিষদ যখন শেষমেশ নড়েচড়ে বসল, জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন আগা শাহির অভিযােগের দাম্ভিক জবাব দিলেন, আমরা ২১ নভেম্বরের পর পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছি বলে পাকিস্তান প্রতিনিধি ঘােষণা করেছেন। অস্বীকার করছি না, আমরা তা করেছিলাম বটে!’
বেলগ্রেডে আমাদের দূতাবাসের বেশির ভাগ কর্মী ও কূটনৈতিক কর্মকর্তাই ছিল বাঙালি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা সব কাজকর্ম ফেলে সবাই মিলে গাদাগাদি করে রেডিওতে যখন যে, কেন্দ্র ধরা যেত, তা-ই শুনতে বসে পড়ত। বিবিসিসহ অন্য যেসব বিদেশি বেতারকেন্দ্র দুঃসংবাদ প্রচার করত, তারা তাকে ভুয়া ও বৈরী প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিত, আর রেডিও পাকিস্তানে শ্রুত পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিমত্তা ও বীরত্বের কাহিনি
পৃষ্ঠা: ১০৯
উত্তেজিত স্বরে আমাকে আবার শােনাত। এর মধ্যে থাকত পাকিস্তানি সৈন্যদের ছােট ছােট দলের বিশাল শত্রু বাহিনীকে রুখে দেওয়ার কথা, থাকত বিধ্বস্ত শট্যাংক ও বিমানের সংখ্যা ও শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ। বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাও শত্রুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের খণ্ড ও ঘােরতর লড়াইয়ের খবর দিচ্ছিল। দীর্ঘ নয়টি মাস অফিসে বাঙালিদের তাদের আসন ছেড়ে উঠতে দেখা যায়নি। তারা রেডিওর ধারেকাছেও ঘেঁষেনি, দূতাবাসের ‘টিকার’ [টেলিগ্রাফে আসা সংবাদ]-এ যেসব সংবাদ সাটা থাকত, সেদিকে ফিরেও তাকাত না। বরং নিজের নিজের আসনে বসে থেকে কর্তব্যনিষ্ঠার সাক্ষ্য হয়ে নীরবে ফাইল লেখালেখিতে বুদ হয়ে থাকত ওরা।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চিম দিকে বেশ এগিয়ে গেল। এসবের মধ্যে ছিল ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন গােটাকয় ভারতীয় বিমানক্ষেত্রের ওপর বিমান হামলা, কাশ্মীরের চম্ব সেক্টরে স্থল আক্রমণ। আর। ইয়াহিয়া সারাটা বছর যে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন, আপাতদৃষ্টে তা শুরু হয়ে গেল। আমেরিকানরা পুরাে ব্যাপারকেই অবাস্তব বলে গণ্য করলেও যখন দেখল তার পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্রটি রাজনৈতিক ও সামরিক হুমকির মুখে, তখন তাদের টনক নড়ল। পাকিস্তান যদি হেরে যায় কিংবা যদি ভারতের আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাহলে সেটা হবে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের বড় পরাজয়। চীনের সঙ্গে সদ্য জোড়া লাগা সম্পর্কের। বিশ্বাসযােগ্যতার ওপরও এটা বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আর এর ফলে এশিয়াতে সােভিয়েতদের প্রাধান্য বেড়ে যাবে। নিক্সন সে সময়কার মার্কিন জনমতের মূল স্রোতকে তােয়াক্কা না করেই ‘পাকিস্তানকে বাঁচাও’ বলে হাঁক ছাড়লেন। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তান বাঁচাও বলে পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার সুযােগ খতম হয়ে গেছে। হেনরি কিসিঞ্জার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক বৈঠকে বলতে বাধ্য হলেন, আমরা সবকিছুই করেছি দুই সপ্তাহ পর, কিছু করার মতাে ক্ষমতা হাত থেকে ফসকে যাওয়ার পর।
৮ ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে নির্দেশ পেলাম, নিউইয়র্কে ভুট্টোর সঙ্গে যােগ দিতে হবে। তিনি সবেমাত্র উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। পাকিস্তানের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে তুলে ধরার দায়িত্ব বর্তেছে তাঁর ওপর। স্থলভাগে সামরিক পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা প্রাণপণে শত্রুর মােকাবিলা করে যাচ্ছে। দু-এক জায়গায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমে কাশ্মীর ফ্রন্টের চম্ব সেক্টরের যুদ্ধে তারা এগিয়েছে। উপরন্তু ওই দিন সকালবেলা সাধারণ পরিষদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি ও পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
পৃষ্ঠা: ১১০
এসবের মধ্যে যখন কিনা ভুট্টো জাতিসংঘে এসে পৌছালেন, বিষয়টির আবেদন ততটা না থাকলেও খেলার মতাে তাস ভুট্টোর হাতে কম ছিল না। ১০ ডিসেম্বরে যখন আমি নিউইয়র্কে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে গিয়ে পৌছালাম, তখন সংশ্লিষ্ট মিশন কর্মকর্তা একটি অপ্রত্যাশিত সংবাদ দিলেন : ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল রাও ফরমান আলীর [পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা] একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠিয়েছেন। ওই বার্তার মােদ্দাকথা হলাে এই যে ইস্টার্ন কমান্ড অস্ত্র সংবরণে প্রস্তুত, সে চায় জাতিসংঘ পাকিস্তানি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের সেখান থেকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুক। খালিদ মাহমুদ নামের ওই কর্মকর্তা আমাকে জানালেন যে ভুট্টো, যিনি কিনা কিছুক্ষণ আগে হােটেলে এসে উঠেছেন, এই ঘটনায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন। আমি সােজা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের পিয়েরে হােটেলে মি. ভুট্টোর হােটেলকক্ষের দিকে। একদম ফাঁকা বসার ঘরের মধ্য দিয়ে গিয়ে দরজায় নক করে বেডরুমে ঢুকলাম। স্বল্পালােকিত একটি কক্ষে সারি সারি রুক্ষ কঠিন চেহারা, জানালার বাইরে সেন্ট্রাল পার্কের পাতাহীন গাছপালার ওপর সন্ধ্যার পড়ন্ত আভা—একনজরেই বােঝা যায়, এ যাত্রায় পাকিস্তানের খেল খতম! জি হুজুর-মার্কা একদল থার্ড সেক্রেটারি এক পাশে জটলা করে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে। আর ভুট্টো স্বয়ং কক্ষটির অন্য প্রান্তে একটি টেবিলে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে একখণ্ড সবুজ কাগজের ওপর দ্রুত হাতে কী যেন লিখে চলেছেন। তাঁর পাশে দাড়ানাে রফি রাজাও [ব্যারিস্টার, পিপিপি-এর নেতা] সবুজরঙা সেই কাগজের ওপর ঝুঁকে আছে। ঠিক একই সময়ে দীর্ঘদেহী, কৃশকায় অথচ ভুড়িওয়ালা এক লােক ছায়ামূর্তিদের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। অসময়ের দর্শনার্থী ভেবে আমাকে সে নিয়ে চলল সেই বসার ঘরটিতে। পেছন থেকে আমাদের লক্ষ করে ভুট্টো বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ বসেন গিয়ে। খানিক বাদেই আমি এসে হাজির হচ্ছি। কৃশকায় ওই লােক আমাকে কোমল পানীয় খেতে দিয়ে নিজেকে একজন কর্নেল বলে পরিচয় দিলেন। সামরিক ঘটনাবলির ব্যাপারে ব্রিফ করার জন্য উপপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন তিনি। আমার বরং মনে হলাে ওর আসল কাজ ভুট্টোর ওপর সারাক্ষণ নজর রাখা! কেউ একজন এসে ফরমান আলীর সেই টেলিগ্রামের একটি কপি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী চান আপনি এটা পড়ে দেখেন। ৮ ওই টেলিগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের আহ্বান জানানাে হয়েছে। ইসলামাবাদ চরম ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করেছে বলেও উল্লেখ রয়েছে। এরপরই এসেছে আসল প্রসঙ্গটি : (১) অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, (২) সশস্ত্র
পৃষ্ঠা: ১১১
বাহিনীকে সসম্মানে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে, (৩) পশ্চিম পাকিস্তানি সব বেসামরিক নাগরিককেও একইভাবে ফেরত পাঠানাে এবং (৪) ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরতদের নিরাপত্তা ও যেকোনাে প্রতিশােধস্পৃহার বিরুদ্ধে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে অনুরােধ। ওই তারবার্তায় জোর দিয়ে বলা হয়, এ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব। একে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব বলে গণ্য করা যাবে না। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের কনসালরা যাতে অবিলম্বে শহরটির (ঢাকা) নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন, টেলিগ্রামে সে প্রস্তাবও রাখা হয়!
উ থান্ট অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ও পাঁচটি স্থায়ী সদস্যকে বার্তাপ্রাপ্তি এবং এর বক্তব্যের কথা জানালেন। উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী চিয়াও কুয়ান হুয়া সাধারণ পরিষদে চীনা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি খবরটি প্রচারে উ থান্টের এ ভূমিকাকে পক্ষপাতিত্ব বলে সমালােচনা করলেন। অন্যদিকে দুদিন পর সােভিয়েত প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য দিতে গিয়ে বললেন, পূর্ব পাকিস্তানেই বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পরিস্থিতিকে বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে আগ্রহী।
জাতিসংঘের করিডরে যখন এ মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে পাকিস্তান যুদ্ধে ইতি টানতে রাজি, তখন ব্যাপারটা পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিশ্বাসযােগ্যতাকে দারুণ খেলাে করল। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের অসমযুদ্ধের শেষ পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে কারও মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। ১৩ ডিসেম্বর ডেভিড হােসেগাে দ্য টাইমস পত্রিকায় লিখলেন, পাকিস্তানি সৈন্য বা ইউনিটগুলাের নিজে থেকে আত্মসমর্পণের বেশ কিছু নজিরও দেখা গেছে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রেরিত বার্তাটি পরিস্থিতির ওপর অন্য রকম আলাে ফেলল। তবু তখনাে আমাদের মিত্রদের মধ্যে কারও কারও ধারণা ছিল যে। আরও দিন কতক নিজেদের অবস্থানে টিকে থাকতে পারলে পাকিস্তানই জয়ী হবে। চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী চিয়াও কুয়ান হুয়া পাকিস্তান মিশনে গিয়ে পরদিন সকালবেলা ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি জোরালাে অনুরােধ করলেন, পাকিস্তানি বাহিনী যেন আর একটা সপ্তাহ প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। চিয়াও বললেন, যুদ্ধ যদি আরও সপ্তাহখানেক চালিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে দারুণ লাভবান হওয়া যাবে। তিনি এ-ও বললেন, বেইজিং এই পরিস্থিতিতে কী। করা যায়, তা খতিয়ে দেখছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও চাপ ও পরামর্শ অব্যাহত ছিল। ঢাকার খবর জেনে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামাবাদকে অনুরােধ করল, আরও অন্তত দুটো দিন যেন লড়াই চালিয়ে যাওয়া হয়। কেননা, এ ব্যাপারে তারা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ মানে
পৃষ্ঠা: ১১২
বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরি ইউএস এন্টারপ্রাইজকে পাঠানাে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা যা, তাতে তেমন কোনাে প্রভাব পড়ার অবকাশ আর ছিল না। তবে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের এই মনােভাবের উদ্দেশ্য ছিল চীনাদের জন্য একটি অনুকূল সংকেত দেওয়া। একটা কিছু করাে এই চাপের মধ্যে থেকে আমেরিকানরা এ অবস্থায় কী ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে চীনারা লিখিত আশ্বাস দাবি করল। চীন-আমেরিকার বন্ধুত্বের ব্যাপারটি তখনাে ছিল নতুন। এ কারণে চীনারা উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছিল, যুক্তরাষ্ট্র হয়তাে চীনকে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এক আত্মঘাতী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজে নিরাপদ দূরত্বে বসে নীরব দর্শকের ভূমিকা নেবে। এ এদিকে ভুট্টো কমপক্ষে আরও একটি সপ্তাহ লড়াই অব্যাহত রেখে পশ্চিম দিকে কার্যকর পাল্টা আঘাত হানার জন্য ইয়াহিয়া খানকে জোরালাে অনুরােধ জানালেন। জবাবে ইয়াহিয়া যে তারবার্তাটি ভুট্টোর কাছে পাঠালেন, তা ছিল দ্ব্যর্থবােধক ও বিভ্রান্তিকর। ওই বার্তায় ফরমান আলীর বার্তাটিকে ‘ভুল’ বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়, আরও এক সপ্তাহ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে আমাদের জন্য মারাত্মক। আর পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে বড় ধরনের পাল্টা আঘাত হানার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আঞ্চলিক সমর অধিনায়কদের ওপর।
পরদিন সকালে মন্ত্রীর (ভুট্টোর) হােটেলকক্ষে প্রতিনিধিদলের বৈঠকে উপস্থিত সবার মাথায় ছিল একটাই প্রশ্ন, চীনারা কি কিছু করবে? নাকি করবে না? ভুট্টোর পেছনে ছায়ার মতাে লেগে থাকা সেই কর্নেল বললেন, আর একটি মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এখনই চীনাদের তরফ থেকে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ জরুরি। চীনাদের পক্ষ থেকে কী করার সম্ভাবনা রয়েছে, ভুট্টো সে ব্যাপারে সবার মতামত জানতে চাইলেন। উত্তর কী হবে, তা তিনি জানতেন, বােধ হয় কূটনীতিকদের যােগ্যতা পরীক্ষা করার জন্যই তিনি প্রশ্নটা করেছিলেন। ত ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের বিষয়টি উত্থাপন করলেন। কোনাে প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি তাৎক্ষণিক বক্তব্য দিলেন। তার দুই ঘণ্টা লম্বা বক্তব্য শেষ হলাে ঠিক মাঝরাতে। পরদিন সকালে দ্য লন্ডন টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদক তার প্রতিবেদনে লিখলেন, মি. ভুট্টোর পরামর্শটা মাত্র পাঁচটি শব্দেই দেওয়া যেত, ‘সক ইট টু দেম বেবি!’ (জোর। আক্রমণ করাে!) এরপরের দিনগুলােতে কোনাে ধরনের হিসাব-নিকাশের সময় আর ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক অবস্থান ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুখ থুবড়ে পড়ছিল। আমাদের সৈন্যদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনীর হাতে যশােরের পতন ঘটল। শেষ মুহূর্তের প্রতিরােধের
পৃষ্ঠা: ১১৩
জন্য আমাদের সৈন্যরা দুটি স্থানে এসে জড়াে হচ্ছিল বলে খবর পাওয়া গেল। (আর এদিকে বিদেশি সাংবাদিকেরা ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যশােরে প্রবেশ করার পরও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম যশাের এখনাে পাকিস্তানের হাতে’ বলে সমানে গলাবাজি চালিয়ে যাচ্ছিল।) অবস্থা এমন দাঁড়াল যে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন যেকোনাে উদ্যোগ মানেই ছিল ভারতের জন্য মওকা। আর এ সুবাদে প্রতিটি উদ্যোগকেই ভন্ডুল করে দিচ্ছিল ওরা। ওই পর্যায়ে এসে ভারতের লক্ষ্য ছিল একটাই—ঢাকা অবরােধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। ওই লক্ষ্য অর্জনে ভারতের দরকার ছিল আর মাত্র কয়েকটি দিন। আর নিরাপত্তা পরিষদের কার্যবিবরণীতে যে সময়ের কথা উল্লেখ ছিল, ভারতের জন্য তা ছিল পর্যাপ্ত। পাকিস্তান মিশনের এক কর্মকর্তা আড়ি পেতে শুনতে পেলেন, একজন ভারতীয় কূটনীতিক সােভিয়েতদের নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্ক মঙ্গল-বুধবার পর্যন্ত স্থগিত রাখতে বলছেন। তাঁদের আশা, ওই সময়ের মধ্যেই ঢাকা ভারতীয়দের কবজায় এসে পড়বে। কথা রাখল সােভিয়েতরা। অকারণে অধিবেশনের কাজ নানা ছলছুতােয় তারা বাধাগ্রস্ত করে চলল : চলল লম্বা বক্তৃতা, পয়েন্ট অব অর্ডার, প্রস্তাব ইত্যাদি। সচরাচর কম কথা বলতে অভ্যস্ত গম্ভীর স্বভাবের কমরেড ইয়াকুব মালিকের কণ্ঠে কথার খই ফুটতে শুরু করল। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রীকে তিনি বর্ণনা করলেন, আমাদের প্রাণের প্রিয়…লেনিনের স্বপ্ন’ ইত্যাদি গালভরা বুলি দিয়ে। সবচেয়ে বড় যে উদ্যোগটা তিনি নিলেন তা হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিরাপত্তা পরিষদে এসে ভাষণ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানাের একটি সােভিয়েত প্রস্তাব। ১৪ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের জন্য ভারতের দাবির পটভূমিতে নিরাপত্তা পরিষদ পরের দিন সকাল নয়টায় নাকি সাড়ে নয়টায় আবার বৈঠকে বসবে, সে নিয়ে বিতর্ক করেই ৪০ মিনিট পার করে দিল।
যুক্তরাজ্য নিজস্ব একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিল। তবে তখনাে তাদের এ ব্যাপারে কাজ শেষ করতে বাকি থাকায় তারা ২৪ ঘণ্টার জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রস্তাব করল। কিন্তু যখন পেশ করার জন্য খসড়াটি চূড়ান্ত করা হলাে, তখন আর সময় নেই। জাতিসংঘে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি আমাদের জানালেন, নিয়াজি যেহেতু ভারতীয় অধিনায়ককে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেছেন, সেহেতু তাঁরা তাঁদের চূড়ান্ত খসড়ায় ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বানটি আর রাখবেন না। আর সােভিয়েতরা এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়ে রাখল, খসড়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও তারা ভেটো দেবে।
নিয়াজি নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনার জন্য কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি’র যে অনুরােধ জানিয়েছিলেন, ভারতীয় পক্ষের অধিনায়ক তাতে
পৃষ্ঠা: ১১৪
সাড়া দিলেন। তবে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের বাইরে কোনাে কিছুই তারা মেনে নেবেন না।
চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ, মনােবল খুইয়ে বসা পাকিস্তানি কমান্ডের ওপর তারা সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সব ধরনের চাপ অব্যাহত রাখল। তারা গভর্নর মালিকের বাসভবনের ওপর বােমাবর্ষণ করে নিয়াজিকে হুঁশিয়ার করে দিল যে, ‘ঢাকার চারপাশ থেকে মরণফাসটা ক্রমশ আঁটসাট করা হচ্ছে। ঢাকার পতন তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গভর্নর মালিক নামাজ আদায় করে কাপা কাঁপা হাতে তার পদত্যাগপত্র লিখলেন। তখনাে আমেরিকানরা আরও কটা দিন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। আগা শাহি আমাকে বললেন, চীন কিছু একটা করতে যাচ্ছে। চীনা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে জল্পনাকল্পনাটা শুরু করেছিলেন আসলে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র। তিনি প্রচার করলেন যে চীন সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের পথে এগােচ্ছে বলে ভারত জানতে পেরেছে। চীনের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে উদ্বেগ ছড়ানাের পেছনে সম্ভবত ভারতের নিজস্ব যুক্তি ছিল। ওই রকম অবস্থায় চীনের করার মতাে আর কীই-বা ছিল? পরদিনই নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে বসলেন আর এভাবে নটে গাছটিও মুড়ালাে। পূর্ব পাকিস্তানে ১০ মাস দীর্ঘ সামরিক অভিযানের পুরাে সময়টা সমস্যার রাজনৈতিক সুরাহার সুযােগ বহুবার হাতে পেয়েও ইয়াহিয়া চক্র তা গ্রহণ করেনি। এমনকি ৪ ডিসেম্বর (ভুট্টো জাতিসংঘে এসে পৌছার আগে) সােভিয়েতরা সংঘাতের রাজনৈতিক সুরাহার আহ্বান জানিয়ে যখন একটি খসড়া প্রস্তাব দিল, তখনাে ইয়াহিয়া চক্র তাতে আমল দেয়নি।
১৫ ডিসেম্বর পােল্যান্ড মােটামুটি গ্রহণযােগ্য একটি প্রস্তাব আনল বটে। কিন্তু তখন সময় হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। নিরাপত্তা পরিষদের লাউঞ্জে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্য চার্লি না’শ আমাকে বললেন, এ মুহূর্তে সমস্যা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচানাে…।’
১৬ ডিসেম্বর বিকেলবেলা ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হলাে। নিউইয়র্কে তখন সকাল নয়টা। টিকারে আত্মসমর্পণের খবর আসতে লাগল। এদিকে ইয়াহিয়ার সর্বশেষ নির্দেশসংবলিত একটি তারবার্তা পৌছাল ভুট্টোর নামে।
নিরাপত্তা পরিষদ হচ্ছে ‘সেই ফ্যাশন হাউস, যেখানে জগতের তাবৎ নােংরামি সুন্দর কথায় মােড়ানাে।’ আগের দিন এই বলে গজরাতে গজরাতে ওয়াকআউট করেছেন ভুট্টো। সদস্যদের উদ্দেশ করে তিনি ক্রুদ্ধস্বরে ঘােষণা করলেন, ‘শিকেয় তুলে রাখাে তােমার নিরাপত্তা পরিষদ। আমাদের দেশের একাংশ অন্যের দখলে চলে যাবে, সেটা হজম করার দলে আমি নেই!
পৃষ্ঠা: ১১৫
এরপরই উঠে দাঁড়িয়ে হাতে ধরা একতাড়া কাগজ ছিড়ে কুটি কুটি করে শূন্যে ছুড়ে মেরে ঝড়ের বেগে অধিবেশন কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পড়িমরি করে পেছনে ছুটলেন একদঙ্গল সাংবাদিক। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল পরিষদ সদস্যরা অপস্রিয়মাণ মূর্তিটির দিকে নীরবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। আর এদিকে ভুট্টোর নিজ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মুহূর্তের জন্য সংবিৎ হারিয়ে পরক্ষণেই বিশৃঙখল হুড়ােহুড়ির মধ্যে ছুটলেন তাঁর পেছন পেছন। আগা শাহিই কেবল দাবি করলেন যে এই কাণ্ডে তিনি মােটেই অবাক হননি। আমাকে তিনি পরে বলেছিলেন, আমি নিশ্চিত যে বৈঠকে আসার আগে ভুট্টো আয়নার সামনে দাড়িয়ে পুরাে ব্যাপারটারই মহড়া দিয়েছে।’
ঢাকায় পল্টন ময়দানে [আসলে হবে রেসকোর্স ময়দান] আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি ছিল দীর্ঘ; শেষে খাবারের আয়ােজনও ছিল। এক ভারতীয় জেনারেলের রুচিতে বাধেনি তাঁর বিজয়ের আনন্দ তারিয়ে উপভােগের জন্য নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসতে। নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ করলেন, তখন জেনারেল-পত্নী তাঁর স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করলেন। অবজারভার পত্রিকার ১৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় গ্যাভিন ইয়ং বর্ণনা লিখলেন সেই ঘটনার। করুণাঘন ভঙ্গিতে তিনি কপালপােড়া ব্যাঘ্ৰ নিয়াজির’ কথা বয়ান করলেন। ওই দিন সকালে পাকিস্তানের স্তৃপাকার সমস্ত অপমানের বােঝা একা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন নিয়াজি। গােড়ার দিকের আস্ফালন ও বুক-চাপড়ানাে বাহাদুরির কারণে তাঁর অপমানের বােঝা আরও বাড়ল। তবে তিনি ছিলেন সেই ভ্রান্ত নীতিরই অসহায় ক্রীড়নকমাত্র, যা ডেকে এনেছে এই বিপর্যয়। গ্যাভিন ইয়ংকে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকান ও চীনারা তাঁকে হস্তক্ষেপ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। এবার দুশ্চিন্তাটা হলাে, বাকি পাকিস্তানের ভাগ্য কী হবে। যুক্তরাষ্ট্র সােভিয়েত ইউনিয়নকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলল, যদি তারা ভারতকে যুদ্ধবিরতি ও দখল ছেড়ে দিতে রাজি না করায়, তাহলে সােভিয়েত-মার্কিনের মধ্যকার সামগ্রিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতকে লক্ষ্য করে কিছু চোখা প্রশ্নবাণ ছুড়লেন, ভারত কি চায় পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে? ভারত কি চায় ১৯৪৮, ৪৯ এবং ‘৫০ সালের গৃহীত জাতিসংঘ সিদ্ধান্তকে তােয়াক্কা না করে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অংশবিশেষ দখল করে নিতে? ভারত আসলে কী চায়, জানার অধিকার বিশ্ববাসীর আছে।
ভারত কী জবাব দেয়, তা শােনার জন্য ১৮ ডিসেম্বর দুপুরবেলা নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসল। শরণ সিং ঘােষণা করলেন, ‘জোরপূর্বক দখল বা অন্য কোনােভাবে পশ্চিম পাকিস্তান বা বাংলাদেশের কোনাে অংশ কুক্ষিগত করার কোনাে দুরভিসন্ধি ভারতের নেই। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান যদি আমাদের
পৃষ্ঠা: ১১৬
নিরাপত্তার ওপর থেকে হুমকি সরিয়ে নেয়, তাহলে আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানকে সামনে রেখে যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহারের যেকোনাে প্রস্তাব সানন্দে বিবেচনা করে দেখব।’
শেষমেশ জুড়ে দেওয়া শর্তটি ছিল কৌতুহলােদ্দীপক। আর তার ঘােষণাটি ছিল যদি’ এবং ‘কিন্তু’র ঘেরাটোপে বাঁধা। উপরন্তু, একটিবারও কাশ্মীর নিয়ে এতে কোনাে কথা বলা হয়নি।
বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ হলেও আধুনিক যুদ্ধ-সংঘাতে হরহামেশাই তা ঘটছে। এর সাক্ষী লেবানন, বসনিয়া ও চেচনিয়া। পাকিস্তানের বেলায় কেবল পূর্ব পাকিস্তানেই তা সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা বারবারই ঘটেছে; ভুট্টোর আমলে বেলুচিস্তানে। এবং জিয়াউল হকের আমলে সিন্ধুতে। তবে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হওয়ার পরও যা ঘটানাে হলাে, এককথায় তাকে মারাত্মক ভুল এবং অপরাধই বলতে হয়। আরও বাজে ব্যাপার হলাে, দেশের সর্ববৃহৎ প্রদেশটিতে ইয়াহিয়া-নির্দেশিত কর্মকাণ্ডের পেছনে কোনাে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয় না এবং তাতে ছিল না কোনাে সঠিক ও যথার্থ কুশলতার ছাপ। বাঙালিদের বেছে বেছে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার মন্ত্রণাদাতারা দেখি না কী হয়’ ভাব করে বসে থেকেছিলেন। এরপর তাদের কী করণীয় এবং কী ঘটে চলেছে, তা তাঁরা জানেন, এমনটি কখনােই মনে হয়নি। ইয়াহিয়া চক্র শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলে পুরে দীর্ঘ প্রায় নয়টি মাস তাকে আটকে রাখল। অথচ তারা তার সঙ্গে গ্রহণযােগ্য মীমাংসায় পৌঁছার কোনাে চেষ্টাই করল না। দেখেশুনে মনে হয়, ইয়াহিয়া চক্রের রাজনৈতিক কৌশলের ভিত্তিমূলে ছিল সেই বালকসুলভ বিশ্বাস, ‘ডান্ডা’ দিলে বাঙালি ‘বাবু’ ঠান্ডা!
অনুবাদ : জুয়েল মাজহার
Reference: ১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান