মাত্র একজন লােক এদেশে এসে নানা বিষয়ের প্রতি এত মানুষের চক্ষু উন্মোচনে এতভাবে সহায়তা করেছিলেন সেরকমটি আর খুব কমই দেখা যায়। সেই মানুষটি আর কেউ নন, লরেন্স লিফশুলজ (Lawrence Lifschulz) নামে একজন সাংবাদিক। এই মার্কিন সাংবাদিক বহুদিন আগে একটি বই লিখেছিলেন, তাতে তিনি বাংলাদেশের দুটি ঘটনাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন তেমনটি এর আগে-পরে খুব কম মানুষই করেছেন। তাঁর ‘বাংলাদেশ : অ্যান আনফিনিশড রিভলিউশন’ বইটির প্রথম অংশে তিনি লিখেছেন কীভাবে পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধা কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান, যাকে কর্নেল তাহেরই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিলেন। কীভাবে তাহেরকে গ্রেফতারের পর নতুন আইন করে সেই আইনের ভূতাপেক্ষিক প্রয়ােগ ঘটিয়ে তাহেরকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। বইটির দ্বিতীয় অংশে আছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করেছিল সেই কাহিনী।
লিফশুলজ আর বাংলাদেশ এসেছিলেন ২০০৫ সালে তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকীতে। এবার তিনি যতটা সম্ভব আরও খােলামেলা কথা বলে গেছেন। কোনাে রাখঢাক না করেই বলে গেছেন কতরকম অন্যায় এবং অবিচার করে গেছেন ক্ষমতালি জিয়াউর বহমান। তিনি এবং ভয়ভীতিতে কম্পিত-হৃদয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েম মিলে তাহেরকে ফাঁসি দেয়ার মতাে অন্যায়কর্মটি করেছিলেন। লিফশুলজ আরও বলেছেন কীভাবে তখনকার সরকারি পক্ষের কৌসুলী এবং পরে দেশের প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজাল নীরব থেকে সেই অপকর্মে সহায়তা করেছিলেন। যেসব বিষয় নিয়ে অনেক মানুষের মনেই নানারকম সন্দেহ এবং প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেসব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে প্রশ্নগুলাের স্পষ্ট পরিষ্কার উত্তর দিয়েছেন তিনি। এর জন্য লিফশুলজ সবারই ধন্যবাদ পাবেন নিঃসন্দেহে। ঠিক এই সময়েই লিফশুলজ আর একটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি উন্মোচন করেছিলেন তাঁর কাছে লেখা তার এক বন্ধু সাংবাদিকের একটি চিঠি হুবহু ছেপে দিয়ে। পাকিস্তানি সেই সাংবাদিকের নাম এম বি নাকতি (MB Nagvi)। তিনি এখনও লেখেন এবং তার কলম প্রায়শই আমরা পড়ি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায়। বঙ্গবন্ধু-হত্যায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের বহুদিনই ভাবিয়েছে। লিফশুলজকে লেখা নাকভির পত্রটি এ বিষয়ে কিছুটা আলােকপাত করেছে।
চিঠিটিতে নাকভি তার বন্ধু লিফশুলজকে সম্বােধন করছেন প্রিয় লিফশুলজ” বলে। তারপর লিখেছেন : I have been an interested reader and admirer of your writngs largely because I share most of your conclusions. With regard to the assassination of Sheikh Mujibur Rahman, I carry a Secrete. (আমি আপনার একজন ভক্ত পাঠক এবং আপনার লেখার প্রশংসা করি, কেননা আমি আপনার সিদ্ধান্তগুলাের সঙ্গে প্রায়শই একমত। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমি একটি গােপনীয় তথ্য জানি)। এরপর তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ওইদিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নাকভিকে ছােট একটি সভায় ডেকেছিলেন পাকিস্তান রেডিওর ডিরেক্টর জেনারেল ইজলাল হায়দার জায়সি। তখন নাকভি পাঁচ বছরের জন্য রেডিও পাকিস্তানের কন্ট্রোলার অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রেডিওর প্রধান ডিরেক্টর জেনারেল জায়নি ছিলেন পাকিস্তানের একজন অত্যন্ত জাদরেল কর্মকর্তা এবং আফগান সেলের প্রধান। ওই সভায় আরও ছিলেন পাকিস্তান বেতারের ডিরেক্টর অব নিউজ, অধুনা প্রয়াত সরদার হুসেন আনসারি। (The meeting was attended by Ijlal Haider Zaidi, then Director General of Radio Pakitan. Late Sardar Hussain Ansari. Director of News and M B Naqvi, who for a brief period of five years the controller of Current Affairs)। খুব সকালেই সভাটি ডেকেছিলেন ইজলাল হায়দার জায়দি। তার মুকুম ছিল, ওই সভা চলাকালীন অফিসের সঙ্গে যেন রেডিওর কেন্দ্রীয় বার্তাকক্ষের একটি হটলাইন খােলা থাকে। বােঝা যাচ্ছিল, তিনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর আসার কথা আগে থেকেই জানতেন। তাই তার নির্দেশটি ছিল, খবরটি যথনই যেভাবে নিউজরুম বা বার্তাকক্ষের টেলিপ্রিন্টারে আসতে থাকবে তেমন লাইন-বাই-লাইন তাকে ওই সভাকক্ষের হটলাইন মারফত জানাতে হবে।
নাকভি এরপর তার চিঠিতে লিখেছেন : সভা শুরু হল কিন্তু দেখা গেল, কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই আলােচনা হচ্ছে না। নানানরকম সাধারণ কথাবার্তা, গল্প, হাসিঠাট্টার মধ্যদিয়ে সময় কাটতে লাগল। চা-কফি পান চলতে লাগল। এর মধ্যে প্রায় তিনচারবার অধৈর্য হয়ে ডিজি জায়দি সংবাদবিষয়ক পরিচালক আনসারিকে জিজ্ঞাস করতে লাগলেন, নতুন কোনাে খবর এসেছে কিনা জানতে। কিন্তু কোনাে খবরই আসছিল না। সময় কাটতে লাগল নানারকম খুচরাে আলােচনার মাধ্যমে। অবশেষে দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে খবরটি এল যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে একটি ফ্লাশ নিউজ। তারপর ধীরে ধীরে খুঁটিনাটি। ইজলাল হায়দার জায়দি দৃশ্যত নিশ্চিন্ত হলেন এবং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। (a sigh of relief escaped from ljlal Haider: he certainly seemed relieved) জায়দি তৎক্ষণাৎ তার সভা সমাপ্ত ঘােষণা করে দিয়ে ছুটলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে খবর দিতে। মনে হল, আয়দি খবরটি পাওয়ার আশাতেই বসেছিলেন এবং খবরটি পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
চিঠির শেষাংশে নাকভি পাকিস্তান বেকারের ওই কর্মকর্তা ইজলাল হায়দার সম্পর্কে বলেছেন ? তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিদায়ের পর কোন্ নীতি গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে আলােচনার জন্য একটি সেল ছিল। সেটির প্রধান ছিলেন ইজশাল হায়দার জায়নি। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের গােয়েন্দা কর্মরত ছিলেন। সেখানে আফগানিস্তানের নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার এবং সােভিয়েত সমর্থিত প্রেসিডেন্ট নছিবের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মুজাদ্দেদি সেপ্টেম্বর মাস থেকে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন।
চিঠিটি এখানে শেষ করে নাকভি লিফশুলজকে বলেছেন। আমার এই সামান্য তথ্যটি বিশ্লেষণ করে আপনি নিশ্চয়ই আরও কোনাে বৃহত্তর সত্যের সন্ধান করতে পারবেন। আমরাও এরকমটিই মনে করি। ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতিতে এশিয়া অঞ্চলে সে-সময় পাকিস্তান যে মােটামুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সহযােগীর ভূমিকা পালন করছিল তা আর কারও অজানা নেই। আফগানিস্তানে তালেবানদের আগমন এবং বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় হত্যা-পরবর্তী দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের প্রতি পাকিস্তানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল তা মেনে না নিয়ে কোনাে উপায় আছে বলে মনে হয় না।
অবশেষে ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট এসে গেছে আমাদের সামনে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ, জি ধরনের শাসন আমরা পেয়েছি দুবছরের জন্য। এই পরিস্থিতিতেই বঙ্গবন্ধু-হত্যার থেমে যাওয়া বিচার আবার শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা প্রয়ােজন। ছয় বছর আগে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার যখন চলেছিল তখন তা কিন্তু কোনাে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে হয়নি। সে সময় অনেকে চেয়েছিলেন, একটি বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেই বিচারকাটি শিগগির সমাধা করা হােক। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার তা করেনি। সেটা না করে যে কত ভালাে হয়েছিল তার প্রমাণ আমরা ইদানীং পেয়েছি। সপ্তাহ কয়েক আগে আমেরিকা থেকে ফেরত আনা হত্যাকারী মেজর মহিউদ্দিনকে কোনাে উপায়ে কানাডায় পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়ে বেশকিছু মানুষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে বিএনপি-জামাতিরা এ-বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন। কানাডা সরকার খানিকটা রাজিও হয়েছিল। কেননা তাদের বােঝানাে হয়েছিল শেখ মুজিব হত্যার বিচার করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি ক্যাঙ্গারু কোটে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু মানুষ যখন কানাডা সরকারের কাছে কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করে যে, ওই বিচার দেশের সাধারণ আদালতে হয়েছিল দীঘদিন ধরে। এবং উভয়পক্ষ পক্ষে-বিপক্ষে সবরকম সাক্ষীসাবুদ উপস্থিত করতে পেরেছিল সেই আদালতে এবং সংবাদমাধ্যমও অবাধে সেসব খবরাখবর প্রচার করেছিল, কেবল তখনই কানাডা সরকার মহিউদ্দিনকে তাদের দেশে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ করব আমাদের আশাবাদ ব্যক্ত করে। এবার ওই বিচার সমাপ্ত হবে এবং যার যা প্রাপ্য শান্তি তাদের সেটুকুই দেয়া হবে। আমরা দায়মুক্ত হব।
যুগান্তর ১৫ আগস্ট ২০০৭
সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী