দৈনিক ইত্তেফাক
২৭শে আগস্ট ১৯৫৮
লীগ আমলের দুর্নীতির বােঝা অন্যের উপর না চাপানাের আবেদন
ন্যাপ নেতৃবৃন্দের বিবৃতির জবাব প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (মঙ্গলবার) এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেনঃ “বিভিন্ন সংবাদপত্রে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা হাজী মােহাম্মদ দানেশ এবং সাংগঠনিক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক জনাব আবদুস সামাদের যে বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে, উহা দেখিয়া যুগপৎ বিস্মিত ও মর্মাহত হইয়াছি।”
শেখ মুজিবুর রহমান বলেনঃ বিবৃতিতে তাঁহারা বিস্তৃত পরিসরে যাহা বলিতে চাহিয়াছেন, তাহা হইল এই যে, আওয়ামী কোয়ালিশন সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল এবং আওয়ামী কোয়ালিশন সরকার প্রদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ঘােরালাে করিয়া তুলিয়াছেন।” শেখ মুজিবুর রহমান বলেনঃ ন্যাপ নেতৃদ্বয়ের বিবৃতি দ্বারা ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁহারা ডাঃ জেকিল ও মিঃ হাইডের দ্বিমুখী ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন। তাহারা পিঠা খাইতেও চান, আবার উহা রাখিতেও চান। তিনি বলেন যে, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদকের সহিত আমার সমঝােতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতে আমার পার্টির নেতৃবৃন্দ এবং আমি সেই সমঝােতার মর্যাদা রক্ষা করিয়া আসিয়াছি। জনাব হাজী সাহেবও তাহার পূর্ববর্তী বিবৃতিতে আমাদের মধ্যকার সমঝােতাকে একান্ত গােপনীয় বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,আমাদের মধ্যকার সমঝােতা নিশ্চিতভাবেই ভদ্রলােকের সমঝােতা এবং উহাকে সেই হিসাবেই বিবেচনা করিতে হইবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ইহা খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আওয়ামী লীগের সহিত কোয়ালিশন করা সত্ত্বেও ন্যাপ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের অনিষ্টকর সমালােচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। যদিও তাঁহাদের ঐসকল অভিযােগের পশ্চাতে ভিত্তি বা সত্যতা বলিয়া কোন কিছুই নাই। আমি জনাব হাজী সাহেব ও জনাব সামাদকে বলিতে চাই যে, আওয়ামী কোয়ালিশন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাসাধ্য সংগ্রাম করিয়াছেন। তাঁহাদের এই কথা জানা উচিত যে, যুগের পর যুগ ধরিয়া সামাজিক অনাচার ও অবিচারের ফলে সমাজদেহে দুর্নীতি দুষ্ট ক্ষতের মতই প্রবেশ লাভ করিয়াছে। মুসলিম লীগের শাসন আমলে মুসলিম লীগ শাসকবর্গের ভ্রান্তনীতি অনুসরণ নেতৃবৃন্দের দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদার মােকাবিলা করার ব্যাপারে ব্যর্থতার ফলে দুর্নীতি আরও বদ্ধমূল হইয়াছে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ইহা সকলেই অবহিত রহিয়াছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে কতিপয় রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দান প্রসঙ্গে ন্যাপের রাতারাতি নীতি পরিবর্তনই পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৩ ধারা জারির জন্য দায়ী। ন্যাপের মনােবৃত্তির পরিবর্তন প্রদেশে নিবর্তনমূলক আটক অর্ডিন্যান্স জারির জন্যও দায়ী। কোয়ালিশনের কোন অঙ্গদল কর্তৃক অনুরূপ নীতি গ্রহণ করিতে আমি আর কখনও দেখি নাই। তিনি বলেন যে,“ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার পর হইতেই তাহারা জনসভায় আমাদের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীর তীব্র সমালােচনা করিয়া আসিতেছেন। অপরপক্ষে আমরা বরাবরই ন্যাপের অনুরূপ সমালােচনা হইতে বিরত রহিয়াছি। জনাব মুজিবুর রহমান বলেন, ন্যাপ যদিও আওয়ামী কোয়ালিশন পার্টির অন্যতম অঙ্গদল, তথাপিও ন্যাপ আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের অনুরূপ সমালােচনায় লিপ্ত হইয়া সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রয়াস পাইতেছে। পরিশেষে তিনি বলেন যে, ন্যাপ নেতৃবৃন্দ যাহা বলিয়াছেন, তাহারা যদি সত্য সত্যই তাহা বিশ্বাস করেন তবে তাহারা যে পার্টি বা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে ঘােরালাে করার অভিযােগ করিয়াছেন,সেই পার্টি বা সরকারকে কেমন করিয়া সমর্থন করিয়া যাইতেছেন?
ইহা কি সত্য নহে যে, প্রদেশের বিগত দুইটি প্রলয়ঙ্করী বন্যার পরে যদি কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতাসীন না থাকিতেন তাহা হইলে অগণিত লােক বেঘােরে জীবন হারাইত? ইহা কি সত্য নহে যে,একটি সুপরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য একটি স্থিতিশীল সরকারের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা আবশ্যক। জনাব সােহরাওয়ার্দী কি অতদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন? ইহাও কি সত্য নয় যে, আওয়ামী লীগ সরকার যথেষ্ট অসুবিধায় থাকা সত্ত্বেও সঙ্কটকালে তাহাদের যথাসাধ্য করিয়াছেন। শুধুমাত্র সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য নিজ কোয়ালিশনের একটি দলের বিরুদ্ধে অনুরূপ প্রচারণা হইতে বিরত হওয়ার জন্য আমি ন্যাপ নেতৃবৃন্দের নিকট আকুল আবেদন করিতেছি। কারণ উহা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই খুব সম্মানজনক পন্থা নহে।