দৈনিক ইত্তেফাক
২১শে নভেম্বর ১৯৫৭
উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে অভূতপূর্ব গণ সমর্থন
সিরাজগঞ্জের বিরাট জনসভায় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মুখােশ উন্মােচন
ট্রাঙ্ক টেলিফোনে প্রাপ্ত
সিরাজগঞ্জ, ২০শে নভেম্বর- এখানে অদ্য অপরাহ্নে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বিপুল জনসমাগম ও আসন্ন উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ। প্রার্থীর সপক্ষে অভূতপূর্ব সমর্থন ও প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ উল্লেখযােগ্য এই যে, অদ্যকার জনসভায় গতকল্য জনাব ভাসানীর জনসভার তুলনায় দ্বিগুণেরও অধিক সংখ্যক শ্রোতার সমাগম হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাদেশিক খাদ্যমন্ত্রী। জনাব মনসুর আলী। সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব। শেখ মুজিবুর রহমান, স্থানীয় প্রভাবশালী জননেতা মওলানা সৈয়দ আসাদদ্দৌলা সিরাজী ও আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তৃতা করেন। জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তাঁহার সুদীর্ঘ বক্তৃতায় দেশে জনস্বার্থের নিশ্চয়তা বিধানে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যপূর্ণ ভূমিকা, জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দীর জোরদার। পররাষ্ট্রনীতি এবং শিল্প ও অপরাপর উন্নয়ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সমতা বিধানের বলিষ্ঠ নীতি এবং ঐ সঙ্গে বরাবরের কায়েমী স্বার্থ-সর্বস্ব কুখ্যাত মুসলীম লীগ এবং উহার গণবিরােধী সমুদয় কার্যকলাপের সমর্থক ন্যাপের রাজনৈতিক ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের জনহিতকর ও দেশসেবামূলক কার্যাবলীর উল্লেখ করিয়া জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, দেশের কয়েক কোটি মানুষ যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হইয়া নিশ্চিত অকাল মৃত্যুর অপেক্ষায় নীরবে মুহূর্ত গণনা করিতে ছিল, ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতা এবং গণ-স্বার্থের ভিত্তি রচনা করিতে গিয়া শত শত রাজনৈতিক বন্দী কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষিপ্ত হইয়া যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিল, ঠিক সেই সংকট ও দুযাের্গপূর্ণ মুহূর্তে দেশসেবার অমলিন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইয়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছিল। স্বীয় আদর্শে অনড় থাকিয়া আওয়ামী লীগ খাদ্য সংকটের নিরসন করিয়াছে এবং শত শত রাজবন্দীকে মুক্তি দান করিয়া ন্যায় নীতি ও গণতন্ত্রের মর্যাদার প্রতি অপার আস্থা এবং শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়াছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের সর্বসম্মত দাবী যুক্ত নির্বাচন প্রথাও প্রবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থ শিকারীর দল পৃথক নির্বাচনের ধুয়া তুলিয়া গণমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে।
তিনি বলেন যে, সামান্য সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের কল্যাণমূলক কার্যে যে সাফল্যের পরিচয় দিয়াছে, উহা একান্তই প্রশংসনীয়। আওয়ামী লীগ-ন্যাপ অশুভ আঁতাতের গণ-বিরােধী ভূমিকা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, জনাব ভাসানী সাহেব রাজস্ব বিভাগের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযােগ করিয়া থাকেন, সেই রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদ আলী।
জনাব ভাসানীর বিমানযােগে সদলবলে সাম্প্রতিক পশ্চিম পাকিস্তান সফরের উল্লেখ করিয়া জনাব মুজিবুর রহমান বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে প্রচারণার খুব সুবিধাজনক স্থান মনে না করিয়াই তিনি দলবল লইয়া পশ্চিম পাকিস্তানে ছুটিয়া গিয়াছিলেন। জনাব মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ হইতে জনাব ভাসানীর পদত্যাগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন হইতে নব গঠিত পার্টির নীতি এবং কার্যকলাপের সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, জনাব ভাসানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে মাত্র ২৫ ভােট পাওয়া সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি আবার সেই মুখেই গণতন্ত্রের বুলি আওড়াইতেছেন। জনাব ভাসানীর সদলবলে সাম্প্রতিক পশ্চিম পাকিস্তান সফরের পুনরুল্লেখ করিয়া প্রশ্ন করেন যে, জনাব ভাসানী সদলবলে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ পাইলেন কোথা হইতে? তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান ছাড়িয়া পশ্চিম পাকিস্তানে ছুটিয়া যাওয়াই জনাব ভাসানীর পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা হারাইবার নিদর্শন। তিনি (জনাব ভাসানী) পশ্চিম পাকিস্তান সফর কালে যে দশ হাজার টাকার তােড়া উপহার পাইয়াছিলেন, উহার আসল উদ্দেশ্য কি, জনাব মুজিবুর রহমান তাহাও জানিতে চান। জনাব সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যের উল্লেখ করিয়া জনাব মুজিবুর রহমান বলেন যে, তাঁহার (সােহরাওয়ার্দী) বলিষ্ঠতর পররাষ্ট্রনীতির জোরে বিদেশে পাকিস্তানের বন্ধুর সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বানচাল করা হইলে উহার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের যে কি পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হইবে, জনাব মুজিবুর রহমান শ্রোতামণ্ডলীকে উহাও সবিস্তার বুঝাইয়া দেন। জনাব সৈয়দ আসাদদ্দৌলা সিরাজী বক্তৃতা প্রসঙ্গে তাঁহার নয় বৎসর কাল মুসলিম লীগের সদস্য থাকাকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিয়া মুসলিম লীগের কুশাসন ও জনস্বার্থ বিরােধী কার্যাবলীর বিস্তৃত বিবরণ বিবৃত করেন।
এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, গতকাল জনাব ভাসানী তাহার জনসভায় সিরাজগঞ্জ উপ-নির্বাচনের ন্যাপ প্রার্থীকে সমর্থনের আহ্বান জানাইয়া সমবেত জনতাকে হস্ত উত্তোলন করিতে বলিলে মাত্র কিছু সংখ্যক শ্রোতা তাহার আহ্বানে সাড়া দেয়। এখানকার পর্যবেক্ষক মহল আওয়ামী লীগ প্রার্থী শতকরা ৭৫টি ভােট লাভ করিবেন বলিয়া দৃঢ় মত প্রকাশ করিতেছেন।