দৈনিক ইত্তেফাক
২৯শে নভেম্বর ১৯৫৭
ভােটার তালিকা প্রণয়নের নির্দেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ
জাতীয় পরিষদে শেখ মুজিবুরের মূলতবী প্রস্তাব অগ্রাহ্য
করাচী, ২৮শে নভেম্বর জাতীয় পরিষদের অদ্যকার অধিবেশনের অধিকাংশ সময়ই বিরােধী দলের সদস্যগণ কর্তৃক উত্থাপিত তিনটি মূলতবী প্রস্তাবের গ্রহণযােগ্যতা সংক্রান্ত আলােচনায় অতিবাহিত হয়।
প্রথম মূলতবী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান (আ: লীগ)। উহাতে ভােটার তালিকা মুদ্রণের কার্য বন্ধ করা ও প্রচলিত আইন লংঘন করিয়া সম্প্রদায় ভিত্তিতে নয়া ভােটার তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়ায় সরকারের নিন্দা করা হয় এবং বিষয়টি একান্ত জরুরি ও জনস্বার্থের দিক হইতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ সম্পর্কে আলােচনার জন্য পরিষদের অধিবেশন মূলতবী রাখার অনুরােধ জানান হয়। শেখ মুজিবুরের মূলতবী প্রস্তাবটির গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে পরিষদে তুমুল বিতর্ক অতিবাহিত হওয়ার পর স্পীকার প্রস্তাবটি বিধিবহির্ভূত বলিয়া ঘােষণা করেন। ‘মীরর পত্রিকার উপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে দ্বিতীয় মূলতবী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন জনাব আব্দুল খালেক (আঃলীগ)। কিন্তু বিষয়টি বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের বিবেচনাধীন থাকায় স্পীকার এই প্রস্তাবটিও বিধি বহির্ভূত বলিয়া ঘােষণা করেন।
গাম্বার রেল দুর্ঘটনা সম্পর্কে সরদার আমীর আজম খান (আ: লীগ) কর্তৃক উত্থাপিত তৃতীয় মূলতবী প্রস্তাবটিই কেবল আলােচনার্থ গৃহীত হয়। আগামী দুই দিনের মধ্যে দুর্ঘটনা সম্পর্কে রেলওয়ে ইন্সপেক্টরের রিপাের্ট ও অন্যান্য তথ্য পরিষদে পেশ করা হইবে-পার্লামেন্টারী দফতরের মন্ত্রী জনাব ইউসুফ হারুণ এই আশ্বাস দিলে সরদার আমীর আজম খান পরে তাহার প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করেন। শেখ মুজিবুরের মূলতবী প্রস্তাব অদ্য অপরাহ্ন ৩টায় স্পীকার জনাব আবদুল ওয়াহাব খানের সভাপতিত্বে পরিষদের অধিবেশন আরম্ভ হয়। কোরান তেলাওয়াতের পর শেখ মুজিবুর রহমান (আ: লীগ) বলেন যে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী ইতিপূর্বে যে ভােটার তালিকা প্রণয়ন করা হইয়াছিল, পাকিস্তান সরকার উহার মুদ্রণ কার্য বন্ধ করার নির্দেশ দিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহারা প্রচলিত আইন লংঘন করিয়া সম্প্রদায় ভিত্তিতে নূতন ভােটার তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়াছেন।
তিনি প্রস্তাব করেন, বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি এবং জনস্বার্থের দিক হইতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় উহা আলােচনার জন্য পরিষদের অধিবেশন মূলতবী রাখা হউক। পার্লামেন্টারী দফতরের মন্ত্রী জনাব ইউসুফ হারুণ (মু.লীগ) উহার সত্যতা অস্বীকার করেন এবং জানান যে, পাকিস্তান সরকার এরূপ কোন নির্দেশ দেন নাই। সর্দার আমীর আজম খান (আঃলীগ) বলেন যে, দেশের জনসাধারণের মনে এই ধারণা জন্মিয়াছে যে, সম্প্রদায় ভিত্তিতে নূতনভাবে ভােটার তালিকা প্রণয়ন করা হইতেছে। তিনি বলেন, ভােটার তালিকা আইন অনুযায়ী প্রণীত নিয়মাবলীর ভিত্তিতেই ভােটার তালিকা প্রণয়নের পদ্ধতি স্থির করিতে হইবে। উহা স্থির না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ভােটার তালিকা প্রণয়নের কাজে অগ্রসর হইতে পারেন না। বাণিজ্য সচিব জনাব ফজলুর রহমান প্রস্তাবটির বিরােধিতা করিয়া বলেন যে, প্রস্তাবে এমন একটি বিষয়ে আলােচনা দাবি করা হইয়াছে, যাহার জন্য সরকার দায়ী নহেন। তিনি বলেন, সরকার অবশ্য ভােটার তালিকা প্রণয়নের পদ্ধতি স্থির করিয়া দিয়াছেন। কারণ, ভােটার তালিকা আইন অনুযায়ী এই অধিকার সরকারের রহিয়াছে। বাণিজ্য সচিব জানান যে, সরকার ভােটার তালিকা মুদ্রণের কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন নাই। কারণ, উহা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সরকার কেবল একটি পদ্ধতি স্থির করিয়া দিয়াছেন। ইফতিখার উদ্দিন প্রস্তাবটি সমর্থন করিয়া বলেন যে, সরকার কোন বেআইনী কাজ করিয়া থাকিলে কেবল তখনই মূলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করা চলে-জনাব ফজলুর রহমান যদি এই ধারণা পােষণ করিয়া থাকেন, তবে তিনি ভুল করিয়াছেন। এক্ষেত্রে নিয়মাবলী পরিবর্তনের অধিকার সরকারের থাকিলেও তাঁহারা অন্যায় করিয়াছেন। কারণ, উহা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, নিয়মাবলী পরিবর্তন করিয়া সরকার এই পরিষদের সিদ্ধান্ত অমান্য করিয়াছেন। কারণ, পরিষদই যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিলেন। অতঃপর প্রাক্তন শিক্ষা সচিব জনাব জহিরুদ্দিন (আঃলীগ) প্রস্তাবটির সমর্থনে বক্তৃতা করিতে উঠিয়া মিয়া ইফতিখার উদ্দীনের যুক্তি সমর্থন করেন এবং বলেন যে, ভােটার তালিকা মুদ্রণের কাজ বন্ধ করার জন্য সরকারই সম্পূর্ণ রূপে দায়ী। -এ,পি,পি।