You dont have javascript enabled! Please enable it! 1957.09.14 | নারায়ণগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী জনাব সােহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৭
নারায়ণগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী জনাব সােহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা
কর্মকুশলতার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে
প্রধানমন্ত্রীকে ‘কায়েদে পাকিস্তান’ আখ্যা দান
লক্ষাধিক লােকের জনসভায় জনাব সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক
আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতি ব্যাখ্যা

এ,পি,পি পরিবেশিত খবরে বলা হইয়াছে: প্রধানমন্ত্রী জনাব সােহরাওয়ার্দী গতকল্য (শুক্রবার) নারায়ণগঞ্জ যে বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন, নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে তাহার নজীর নাই। প্রধানমন্ত্রীর নারায়ণগঞ্জ গমনকালে শহরের একমাইল দূর হইতে সভাস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত পথের উভয় পার্শ্বে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার হাজার নাগরিক সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান থাকিয়া ‘মুহুর্মুহু জিন্দাবাদ ধ্বনির দ্বারা প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়। আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী যখন বক্তৃতার জন্য দণ্ডায়মান হন, শ্রোতার সংখ্যা তখন লক্ষের কোঠায় গিয়া পৌছে। সুদূর গ্রামাঞ্চল হইতে আগত নাগরিকদের যােগদানের ফলে জনসভার কলেবর ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে সভাস্থলে আগমনের পর ‘সবুজ সেনারা প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও বারােটি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ হইতে প্রধানমন্ত্রীকে বিপুলভাবে মাল্য ভূষিত করা হয় এবং প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে কায়েদে পাকিস্তান আখ্যায়িত করিয়া তাহার সেবাধর্মী তৎপরতা ও কর্মকুশলতার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া পৃথক পৃথক মানপত্র প্রদান করা হয়।
‘ইত্তেফাক’-এর স্টাফ রিপাের্টার জানাইতেছেন যে, গতকল্যকার নারায়ণগঞ্জের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দেশবাসীর কর্তব্য বিশ্লেষণ করিয়া ৪৫ মিনিট যাবৎ বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ করিয়া পাক-ভারত সম্পর্কের প্রশ্নে কাশ্মীর ও খালের পানির বিরােধের ব্যাপারে ভারতের দ্বিমুখী নীতির মুখােশ উম্মােচন করিয়া জনতার উল্লাসধ্বনির মধ্যে দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, মি. নেহরু পাকিস্তানের সহিত শান্তিতে বসবাসের নীতির দোহাই দিন না কেন, কাশ্মীর ও খালের পানি বিরােধের ব্যাপারে তিনি ও তাঁহার সরকার ন্যায় নীতির পরিচয় না দিলে পাকিস্তান কখনই তাহাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হইতে পারে না।
তুমূল করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করেন, খাল ও নদীর পানি বন্ধের ফন্দিতে মাতিয়া ভারত পাকিস্তানকে শুকাইয়া মারিবার কোশেশই করুক না কেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা না হইলে পাকিস্তান তাহাকে সমুচিত শিক্ষাই দিবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগের উদ্যোগে তথায় মিউনিসিপ্যাল পার্কে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষাধিক লােকের বিরাট জনতা ‘জনাব সােহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তােলে। বস্তুত: প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ নগরী উৎসব মুখর হইয়া উঠে এবং চতুর্দিক হইতে নগরবাসী আসিয়া প্রধানমন্ত্রী সন্দর্শনের জন্য পথিপার্শ্বে সমবেত হয়। নেতার সম্মানার্থে নগরীতে কয়েকটি তােরণ নির্মিত হয়। অপরাহ্নে পৌনে পাঁচ ঘটিকায় জনাব সােহরাওয়ার্দী সভাস্থলে উপনীত হন। তিনি গাড়ী হইতে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে অযুতকণ্ঠের সােহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ ধ্বনিতে সভাস্থল প্রকম্পিত হইয়া উঠে। জনাব সােহরাওয়ার্দী মঞ্চোপরি দণ্ডায়মান হইলে জনতা তাহাকে নিকট হইতে দেখিবার জন্য বাধ ভাঙ্গা বন্যার ন্যায় সম্মুখে অগ্রসর হয়। সভাস্থলে এত অধিক লােকের সমাগম হয় যে, পার্কের চতুর্দিকের রাস্তার যানবাহন চলাচল বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় এবং বহু লােক বৃক্ষোপরি আরােহণ করিয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শােনার জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। পুলিসের পক্ষে এই বিপুল জনতা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হইয়া পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শান্ত হওয়ার আবেদন জানাইলে জনতা বক্তৃতা শােনার জন্য মন্ত্রমুগ্ধর ন্যায় মাটিতে বসিয়া পড়ে।
শেখ মুজিবুর রহমান
সভায় প্রথমে আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান জনাব সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া বলেন, আমার বক্তৃতা করার কিছু নাই। জনাব সােহরাওয়ার্দী প্রমুখ বীর সেনানীর সহযােগিতায় কায়েদে আজম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন; আজ সেই পাকিস্তানকে ঘরে বাইরে সমৃদ্ধি ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন জনাব সােহরাওয়ার্দী। দেশবাসীর জন্য যিনি জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, এক্ষণে আপনারা তাহার বক্তৃতাই শুনুন।
জনাব সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা
জনাব সােহরাওয়ার্দী বক্তৃতা শুরু করিয়া বলেন, নারায়ণগঞ্জে এতবড় জনসভার কথা আমি কল্পনাও করিতে পারি নাই। আপনাদের এই সমাবেশ আমার প্রতি আপনাদের মহব্বতের পরিচয়ই বহন করে এবং এজন্য আমি আপনাদের মােবারকবাদ জানাইতেছি। আপনাদের এই অকৃত্রিম কথা তাহাদের বুঝাইয়া বলিয়াছি। তাহারা আমাদের নীতি বুঝিয়াছেন এবং কাশ্মীর প্রশ্নেও আমাদের দাবীর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করিয়াছেন।
কাশ্মীর ও ভারত
জনাব সােহরাওয়ার্দী অতঃপর বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মি. নেহরু কয়েক দিন পূর্বে বলিয়াছেন যে, তিনি পাকিস্তানের সহিত শান্তি চাহেন এবং তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষপাতি। আমি পূর্বেও বলিয়াছি এবং এখনও বলিতেছি যে, আমরাও ভারতের সহিত শান্তিতে বসবাস করিতে চাহি এবং আমরাও সত্য ও ন্যায়ের পক্ষপাতি। কিন্তু বলপূর্বক কাশ্মীর দখল করিয়া মি. নেহেরু যেরূপ ‘ন্যায় নীতির পরিচয় দিয়াছেন ও দিতেছেন সেই রকম ন্যায় নীতি সমর্থন করি না। তিনি সত্যিই যদি ন্যায়নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তবে আসুন, বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত জাতিসংঘ কাশ্মীরের ব্যাপারে যে অভিমত ব্যক্ত করিয়াছে তাহা মানিয়া লউন। তবে মি. নেহেরু মনে রাখিবেন যে যত ছলছুতার আশ্রয়ই তিনি লননা কেন বিশ্বজনমতের নিকট তাহাকে নতি স্বীকার করিতে হইবেই। তিনি খালের পানি বন্ধ করিয়া দিয়া আমাদের ভাতে মারার চেষ্টায় আছেন, কিন্তু এ কথাও তিনি জানিয়া রাখুন যে, মরার আগে আমরা সমুচিত জবাব দিয়াই মরিব।