প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১৬ জানুয়ারি ১৯৭২
ঢাকা
পূর্ণ ভাষণের টেক্সট –
আমার ভায়েরা ও বোনেরা,
আপনারা একটু শান্ত হন। আপনারা কষ্ট করে না আসলেও পারতেন। আমি জানি যে রাত্রে আমাকে গ্রেফতার করে, সেই রাত্রে আপনাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালায় দেওয়া হয়। আমাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তখন আমি দেখতে পেয়েছিলাম যাদের ঘর নাই, ছোট ছোট কুঁড়েঘর বানাইয়া আছে, সেগুলোও জালিম পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকগুলো পোঁড়ায় দিয়েছিলো আমি জানি যে আজ স্বাধীনতা পেয়েছি। আপনারা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। কিন্তু কতো রক্ত দিতে হয়েছে তার হিসাব এখনো নাই। কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিরিশ লক্ষ লোক মৃত্যুবরন করে নাই। লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জালেমের দল চলে গিয়েছে সত্য, আমার দেশের সাত কোটি লোককে বাস্তুহারা করে গেছে।
কিন্তু আমার মাটি আছে, আমার মানুষ আছে, আমার ঈমান আছে। আমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সোনার বাংলাকে নতুন করে গড়তে হবে এবং নতুন করে মানুষের খাওয়া পরার বন্দোবস্ত করতে হবে। ধৈর্য্যের প্রয়োজন আছে। আপনারা শহরে আছেন। আমি আপনাদের বহু আগে বলেছিলাম আপনাদের জন্য শীঘ্রই আমি একটা জমির বন্দোবস্ত করবো। সেখানে আপনাদের সকলে এক জায়গাতে আপনাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে হবে। রাস্তাঘাটে, এখানে ওখানে বাড়িঘর আপনারা যা করেছেন, আপাতত থাকেন। আমি আমার ছোটো ভাইকে বলে দিয়েছি লিস্ট বানাও, কতো আমার বাস্তুহারা ঢাকা শহরে আছে। তাদের জন্য আমি একটা জমি এরিয়ার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। আপনারা সব সেখানে উঠে নিয়ে আপনাদের জাগায় (জায়গায়) থাকবেন, পরে আমি আপনাদের জন্য ঘরবাড়ি কি করতে পারি দেখবো। আপনারা ধৈর্য্য ধরেন। কেউ … আইন শৃঙ্খলা রাখতে হবে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। টাকা নাই, পয়সা নাই, চাল নাই, অর্থ নাই, কাপড় নাই, জামা নাই, কিচ্ছুই নাই। কিছু কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী জিনিষপত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে। তাদের জানা উচিত এই যে বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলার সরকার, দুষ্কৃতিকারীদের ক্ষমা করবেনা। তাদের আমি অনুরোধ করছি জিনিষপত্রের দাম বাড়াতে পারবেনা। যাতে ন্যায্যমূল্যে আমার জনসাধারণ জিনিষপত্র পায় সেদিকে খেয়াল রাখবে। নাহলে ভবিষ্যত তোমাদের অন্ধকার হয়ে যাবে। আমি আপনাদের কাছে বলবো যে আমি খবর পাই জাগায় জাগায় দুই জাগা দুয়েক জাগাতে একজন আরেকজনের উপর অত্যাচার করা হয়। স্বাধীনতা মানে বিশৃঙ্খলা নয়। স্বাধীনতা মানে গুন্ডামী, বদমায়েশি নয়। স্বাধীনতা মানে একজনের উপর জুলুম করে পয়সা অর্জন করা নয়। স্বাধীনতা মানে মানুষ মুক্ত দেশের মুক্ত মানুষ, যারা সসম্মানে ইজ্জতের সঙ্গে বাস করবে এবং তারা মানুষের মতো বাস করবে। এই সমাজে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিজ্ঞা আমি গ্রহন করেছি। আমি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসেছি। লক্ষ লক্ষ মা-বোন ভাই আমার জীবন দিয়েছে। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিজ্ঞা আমি গ্রহণ করেছি। আমি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসেছি। লক্ষ লক্ষ মা-বোন ভাই আমার জীবন দিয়েছে। তিরিশ লক্ষ লোক কে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার মা-বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। আমার দেশের মানুষের ঘরবাড়ি পোঁড়ায় দেয়া হয়েছে। স্কুল কলেজ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যা করেছে নমরুদ ফেরাউন বোধহয় লজ্জা পেতো, যা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকেরা করেছে। চিন্তা নাই। আমার এতো সুন্দর জনগন, আমার এমন সোনার মানুষ আর আমার এই সোনার বাংলাদেশ; ধৈর্য্য ধরে যদি কাজ করেন সকলে মিলে ইনশাল্লাহ নতুন সমাজ গড়ে তুলতে পারবো। আমার কোনো লোভ নাই, আপনারা জানেন। প্রধানমন্ত্রী আমি সমগ্র সারা পাকিস্তানের হতে পারতাম, আপনারা জানেন। আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমি চাই নাই, আমি চেয়েছিলাম ফাঁসিকাষ্ঠ- এইজন্য যে বাংলার মানুষকে আমি অপমান করতে চাইনা। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো আপনারা আইনশৃঙ্খলা যাতে রক্ষা পায় তার দিকে নজর রাখবেন। একজন আরেকজনের উপর অত্যাচার করবেন না। আর দ্বিতীয় কথা আমার বাস্তহারা ভাইরা সাতকোটি বাঙালী আজ বাস্তুহারা হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি গ্রামে গ্রামে পোঁড়ায় দিয়েছে। এজন্য বারবার একথা আমি বলছি। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যতো তাড়াতাড়ি হয় আপনাদের নিজের জাগার বন্দোবস্ত আমি করে দিচ্ছি। এখানে ওখানে ওখানে রাস্তার পাশে এভাবে থাকলে চলবেনা। কারন আপনাদের অসুবিধা জনসাধারনে অসুবিধা, আপনাদের কষ্ট জনসাধারনের কষ্ট। একটা এরিয়া আমি দেবো যার মধ্যে আপনারা সুখে স্বচ্ছন্দ্যে এবং ঐ জাগা আপনার নিজের জাগা হবে। আমি (…..) কে বলেছি ১৫ দিন সময় দিলাম ১৫ দিনের মধ্যে লিস্ট করে তুমি আমার কাছে পৌঁছিয়ে দিবা। আমি আশা করি এক-দুইমাসের মধ্যে বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। আপনারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আজ আমি দেখি আমার এই নীল আকাশের তলে এই সবুজ মাঠে ঐ আমার জাতীয় পতাকা উঠে। ঐ পতাকায় আপনারা সালাম দেন। আল্লাহর উপর নির্ভর করেন, আল্লাহর উপর নির্ভর করে আপনারা দোয়া করেন আমার সহকর্মীদের যেনো সকলে ঈমানের সঙ্গে রাখে ও আপনাদের জন্য যেভাবে দেশের যুবক ছেলেরা রক্ত দিয়েছে, সমস্ত দলের মুক্তিবাহিনী যারা জীবন দিয়েছে, আমার সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছে, পুলিশ রক্ত দিয়েছে, বুদ্ধিজীবী রক্ত দিয়েছে, মা-বোনেরা রক্ত দিয়েছে এই রক্ত যেনো বৃথা না যায়। আজ যারা রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা দিয়ে গেলো তারা মরে নাই, তাদের আত্মা বেঁচে আছে।তারা দেখবে তাদের আত্মা দেখবে যে বাংলার মানুষ সুখে বাস করছে কিনা, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাচ্ছে কিনা, বাংলার মানুষ শান্তিতে বাস করছে কিনা। ওদের আত্মা সেদিন শান্তি পাবে যেদিন আপনারা পেট ভরে ভাত খাবেন, গায়ে আপনাদের কাপড় হবে, থাকার বন্দোবস্ত হবে, বেকার সমস্যা দূর হবে। সেই দিনই আমি সত্যিকারের স্বাধীন বাংলার নাগরিক হিসেবে আপনাদের দাবী করতে পারবো। এর আগে আমার দাবী করার অধিকার নাই। আমার … আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি বিদায় নিচ্ছি।
বলেন –
জয় বাংলা, জয় বাংলা (জনগণ একসাথে),
জয় বাংলা, জয় বাংলা (জনগণ একসাথে),
আমার দেশ-তোমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ (জনগণ একসাথে),
আমার দেশ-তোমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ (জনগণ একসাথে),
আমার দেশ-তোমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ(জনগণ একসাথে),
জয় বাংলা, জয় বাংলা (জনগণ একসাথে)।
জয় বাংলা, জয় বাংলা (জনগণ একসাথে)।
আসসালামু আলাইকুম।
Reference:
পিপলস ভয়েস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক