You dont have javascript enabled! Please enable it!

চলমান হত্যা ও গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে বিবৃতি
২৫ মার্চ ১৯৭১
ঢাকা

প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন ও তার পরবর্তী আলোচনা থেকে জনগণের একটা ধারণা হয়েছিল যে, দেশে বিরাজমান গভীর সঙ্কট সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের চেতনার সৃষ্টি হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবে তা সমাধান সম্ভব। এ কারণেই আমি প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করি। প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন যে, সঙ্কট কেবল রাজনৈতিকভাবেই সমাধান সম্ভব। সে আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট যেসব মৌলিক নীতির ভিত্তিতে সঙ্কটের সমাধান হতে পারে তা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে আমার সহকর্মীরা প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সাথে সেসব নীতি নির্ধারণের জন্য বৈঠকে মিলিত হন।

এভাবে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানের পূর্ণ বাস্তবায়নে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছি। বিলম্বের কোন কারণ বা যৌক্তিকতা নাই। সংশ্লিষ্টরা যদি রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেন, তবে তাঁদের এটা বোঝা উচিত যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদেরকে তাড়াতাড়ি করতে হবে নতুবা এ ব্যাপারে কোনো বিলম্ব দেশ ও দেশের মানুষকে গভীর সঙ্কটে নিপতিত করবে। তাই সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানে অনভিপ্রেত বিলম্ব দুঃখজনক। ইতোমধ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি একের পর এক সেনাবাহিনীর তৎপরতায় আরো জটিল করে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী এ তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে। সৈয়দপুর, রংপুর ও জয়দেবপুর সেনাবাহিনীর তৎপরতার সংবাদে আমি মর্মাহত। বেসামরিক লোকদের উপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ ও তাদের উপর। অত্যাচারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের খবর আসছে।

এটা আরো দুঃখজনক এজন্যে যে, সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের ঘোষিত উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের ঢাকা উপস্থিতির কালে এসব ঘটনা ঘটছে। অবিলম্বে এসব সামরিক অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এটা জেনে রাখা উচিত যে, এভাবে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা এবং অত্যাচার বিনা চ্যালেঞ্জে পার পাবে না। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের বীর সন্তানেরা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির যে চরম লক্ষ্য তা অর্জনে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে। যেটা আরো নিন্দনীয় তা হচ্ছে এই যে, স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্যে গণবিরোধী শক্তি একটি মহলকে নিয়োজিত করেছে। আমি একাধিকবার বলেছি, যারা বাংলাদেশে বাস করেন তারা যে জায়গা থেকেই এসে থাকুন না কেন বা যে ভাষায়ই কথা বলেন না কেন-তারা সবাই আমাদের লোক এবং তারাও তা মনে করবেন এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করবেন। তাদের জান-মাল-সম্মান আমাদের পবিত্র আমানত।
এটা তাই স্পষ্ট যে যারা উত্তেজনা সৃষ্টি করছে তারা একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা বানচাল করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণ চালাবার অজুহাত সৃষ্টি করার জন্যেই তা করছি। বিশ্ববাসী আজ দেখুক, একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে আমরা যখন যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, তখন জোর করে একটি সমাধান চাপিয়ে দিতে একটি অশুভ চক্র শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের সেসব অশুভ শক্তিকে আমি জানিয়ে দিতে চাই, তাদের চক্রান্ত সফল হবে না, কারণ জোর করিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যে গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন চালানো হয়েছে আমি তার নিন্দা করি। এ ধরনের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সারা বাংলাদেশব্যাপী হরতাল পালিত হবে। সামরিক বাহিনী ও নিরস্ত্র বেসামরিক লোকের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি সষ্টি না করার জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানাচ্ছি। তারা যদি এতে কর্ণপাত না করেন- সামরিক সংঘর্ষের পথ বেছে নেন, তবে একটি রাজনৈতিক সমাধান বানচাল করা এবং তার মারাত্মক পরিণতির জন্যে তারাই পুরোপুরি দায়ী থাকবেন।

আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে আমি আমাদের বীর জনগণকে আহ্বান জানাই। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবে চালু রাখতে হবে। সর্বাধিক দক্ষতার সাথে যাতে অর্থনীতি চালু থাকে- তা নিশ্চিত করা প্রত্যেকের পবিত্র দায়িত্ব মনে করতে হবে। এ ব্যাপারে কল-কারখানায় আমাদের শ্রমিকদের একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে। সর্বাধিক উৎপাদনের জন্যে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে তাদেরকে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের আন্দোলন এগিয়ে যাবে। সময়ে সময়ে ব্যাখ্যা দেয়া সাপেক্ষে ১৪ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে জারিকৃত নির্দেশাবলী বলবৎ থাকবে।

Reference:
দ্যা ডন, করাচী, ২৬ মার্চ ১৯৭১
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আনু মাহমুদ, পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৫, প্রকাশকাল ২০১৭, ঢাকা, ন্যাশনাল পাবলিকেশন
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!