You dont have javascript enabled! Please enable it!

৭ মার্চ সন্ধ্যায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি
৭ মার্চ ১৯৭১
ঢাকা

পহেলা মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ (শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র) যারা জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে যারা প্রাণ দিয়েছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার স্বেচ্ছাচারমূলক ও অযাচিত কাজের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে গিয়েই তারা শহীদ হয়েছেন। এই শহীদদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বলে চিত্রিত করা সত্যের অপলাপ মাত্র। সত্যিকারের ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য যারা দায়ী বস্তুতপক্ষে তারাই হচ্ছে আসল দুষ্কৃতকারী। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ অবস্থার অবতারণা করা হয়েছে তা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসার একটু সময় করতেও সক্ষম হন নি। প্রেসিডেন্ট যাকে ক্ষমতার ন্যূনতম প্রয়োগ বলে অভিহিত করেছেন, তার ফলেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হয়ে থাকে, তাহলে কি আমাদের এটাই বুঝতে হবে যে, তিনি যাকে পর্যাপ্ত ক্ষমতার প্রয়োগ বলবেন, তার লক্ষ্য হবে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার এই নগ্ন হুমকির আমি নিন্দা করছি। জাতী অনেক অর্থব্যয়ে সশস্ত্রবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেছে বিদেশী হামলা প্রতিহত করার জন্য, বেসামরিক নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য নয়। অপর অঞ্চলের উর্দি পরা সৈনিকরা যে বাড়াবাড়ি করছে, তারা দখলকারী বাহিনীর মতো যে ভূমিকা পালন করছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের আজ রক্ষা-ব্যবস্থা প্রয়োজন। বলা হয়েছে যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখাকে ভুল বোঝা হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করতে চাই, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছুসংখ্যক সদস্য এবং একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ঘোষিত অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যালঘু দলের একক খেয়ালের প্রতি সাড়া দিয়েই কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয় নাই?

আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিলাম। অপরদিকে উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপটি চেয়েছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন হোক। এই সংখ্যালঘু গ্রুপটির মতের কাছেই নতি স্বীকার করা হয়েছে এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও সেই সংখ্যালঘু গ্রুপটি পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আপত্তি উত্থাপন করেছে। প্রথমত এই সংখ্যালঘু গ্রুপ একটি অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য উত্থাপন করে বলেছে যে, ঢাকা এলে এর সদস্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং তারা ডবল জিম্মি হয়ে যাবে। এরপর এই দল থেকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে, তারা যেসব শর্ত আরোপ করবে তা মেনে নিলেই শুধু তারা পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে। এরপর আরেক পর্যায়ে এই সংখ্যালঘু গ্রুপের সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগেরও সিদ্ধান্ত নেয়। সবচেয়ে যা বিস্ময়কর তা হলো এই যে, উক্ত গ্রুপের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই আইনগত কাঠামো আদেশে আনা হলো একটি সংশোধনী। এতে বলা হলো পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই সদস্যরা ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করতে পারবেন। কিন্তু এরপর উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিলেন পদত্যাগ না করার। এই দলের এই এলোপাতাড়ি ইচ্ছাআনচ্ছা চরমে পৌছলো ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এই দল থেকে ঘোষণা করা। হলো যে, এই দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া যদি পরিষদের অধিবেশন বসে তাহলে এই দল এক গণআন্দোলন শুরু করবে। এই দল এতদূর পর্যন্ত বলতে পারল যে, পারিষদের অধিবেশনে যারা যোগদান করবে, তাদের ওপর জনগণ পূর্ণ প্রতিশোধ নেবে এবং জনগণ যদি প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই দলটিই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই দলটি থেকে আরো ভয় দেয়া হয় যে, এই দলের কোনো সদস্য যদি পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে দলীয় কর্মীরাই তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের পার্লামেন্টারি পার্টি ঢাকায় সমবেত হন এবং পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও পরিষদ সদস্যরা ঢাকা আসতে শুরু করেন।

প্রধান নির্বাচনী কমিশনারও ঢাকা এসে পৌঁছেন এবং ২ মার্চ পরিষদের মহিলা সদস্যদের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্টের নিজেরও ১ মার্চ ঢাকা আসার সম্ভাবনা ছিল।। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের নিজেদের অবস্থানও আমরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিবৃতি করেছিলাম ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রদত্ত আমাদের বিবৃতিতে। এতে আমরা পাকিস্তানের প্রত্যেক অংশ থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিটি সদস্যকে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এই ঐতিহাসিক কাজে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা এই পর্যন্তও বলেছিলাম যে, কোনো সদস্য ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত কিছু পরিষদে উত্থাপন করলে আমরা তা মেনে নেবো। কিন্তু সে প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয় এবং তা করা হয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে।

পহেলা মার্চ এক বেতার বিবৃতিতে আকস্মিক ও অহেতুকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। এজন্য অজুহাত দেখানো হয়, সমঝোতা সৃষ্টির জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এ কথা বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলছে। বাংলাদেশের মানুষ কি এর থেকে মনে করতে পারে না যে, একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নির্দেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে? তারা কি যুক্তিসঙ্গতভাবেই ভাবতে পারে না যে, একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যাহত করা এবং সংখ্যাগুরু জনসাধারণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কতিপয় শাক্তর সাথে হাত মিলিয়েছে? দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে এসব সন্দেহ আরো দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। এতে প্রমাণ হয় রাজনৈতিক বিরোধ অচিরেই সামরিক বিরোধের রূপ নিচ্ছে, যদি না সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর নির্দেশের কাছে মাথা নত করে।

কার্যত ২৪ ফেব্রুয়ারির বিবৃতিতে আরো হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, যখনই আমাদের দেশে জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গেছে তখনই জঘন্য চক্রান্তকারীরা তাতে হস্তক্ষেপ করেছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ গোটা কয় ব্যক্তি গণতন্ত্রকে বানচাল করে বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষকে বঞ্চনা করেছে, তেমনি পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানষকেও তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ১৯৫৩ এনে ক্ষমতাসীন পাঞ্জাবি জোটের চক্রান্তে বাঙালি প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। একই চক্র ১৯৫৪ সালে বাংলার নির্বাচিত সরকার এবং খোদ গণপরিষদকেই ভেঙে দেয়। ১৯৫৯ সালের গোড়ার দিকে সাধারণ নির্বাচন হবার কথা ছিল, পাঞ্জাবের কায়েমি স্বার্থ সেখানেও আবার আঘাত হানে এবং ক্ষমতা জবরদখল করে নেয়। কিন্তু তাদের এ কথা জেনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাগ্রত জনসাধারণ এবং পশ্চিমাঞ্চলের নির্যাতিত জনতা সম্ভাব্য সব উপায়ে তাদের এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করবেই।

সত্যের খাতিরে আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই, গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হোক, এ ধরনের কোনো ধারণাই আমি দিই নাই। আমি প্রেসিডেন্টকে কেবল এই কথাই জানিয়ে দিয়েছিলাম, বাংলাদেশে কি মারাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা দেখা এবং যথেচ্ছাভাবে নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তার ঢাকা আসা উচিত। প্রেসিডেন্ট প্রস্তাবিত পূর্ববর্তী বৈঠকের ব্যাপারে ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই কার্যনির্বাহী কমিটি ও পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তখন আমাদের পক্ষে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়া সম্ভব ছিল না। অধিকন্তু, আমরা এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, শাসনতান্ত্রিক সমস্যাদি গোপন আলোচনার বদলে জাতীয় পরিষদ ও তার কমিটিসমূহের মাঝেই সমাধান করা উচিত এবং একবার জাতীয় পরিষদ গঠিত হবার পর গোলটেবিল কিংবা গোপন বৈঠকের কোনেবা যুক্তিই নাই। আওয়ামী লীগ কোনোভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে এ আভযোগের জবাবেই আমি এসব কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম। এধরনের বাধা সৃষ্টি থেকে যাদের ফায়দা হতে পারে সংখ্যাগুরু দল তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। দেশের জনসাধারণ এবং কার্যত সারা বিশ্বের কাছেই একথা পরিষ্কার যে, পশ্চিমাঞ্চলের একটি সংধ্যালঘু গ্রুপ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিজে এই সংখ্যালঘু চক্রটির নির্দেশে নতি স্বীকার করাকেই কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছেন। একটি সংখ্যালঘু চক্র যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেই বানচাল করার জন্য কায়েমি স্বার্থের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয় তবে গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা কায়েম কিংবা জনসাধারণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অসম্ভব। শেষপর্যন্ত যদি গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হয় তবে তার দায়িত্ব এই সংখ্যালঘু চক্র এবং তার সাথে চক্রান্তকারীদেরই বইতে হবে।

এসব মহলই কি সেই ‘গুটিকয় লোক’ নয়, যারা একত্রে বসবাসের ভিত্তি উদ্ভাবনের জন্য জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টার উপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে? প্রতিটি সুস্থমনা ব্যক্তিই আজ যে প্রশ্নটি উত্থাপন করবেন তা হচ্ছে: বাংলাদেশের সর্বত্র নিরস্ত্র জনতাকে গুলি করে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সংহতি, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করেছে, না অন্য কিছু? এ ভূমিকা নিয়ে তারা কি কার্যত বিচ্ছিন্নতার প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করছে না? নির্বাচন হয়ে যাবার পর এখন দেশে ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। কোনো ব্যক্তিবিশেষই নিজেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে দাবি করতে পারেন না।
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এটা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই একমাত্র বৈধ উৎস। গত সাত দিনের ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদেরকে বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলী মেনে চলেছে।

প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদস্থ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। কাজেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ না করা বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এরপর আমাদের আসতে হয় আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথায়। আমরা বহুবার এ অধিবেশন আহ্বানের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছি। কিন্তু আজ এক অস্বাভাবিক এবং মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণকে সামরিক শক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার নীতির অনুসরণে প্রকৃতপক্ষে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র সুবিবেচক জনগণসহ সবদিক থেকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে বলে আওয়াজ তোলা হচ্ছে।

জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ভীতিপ্রদ পরিবেশে কাজ করবেন এটা আশা করা যায়না। যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আমদানিসহ এই নির্যাতনের পরিবেশ অব্যাহত থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বেসামরিক জনতার উপর প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর আসতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা বন্দুকের মুখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয় বিবেচনা করবেন, এটা আশা করা যায় না।

যদি প্রেসিডেন্ট আন্তরিকভাবে কামনা করেন যে, জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, তাহলে অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে :

(ক) অবিলম্বে সকল সৈন্যকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।
(খ) বেসামরিক জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, যাতে এখন থেকে একটা বুলেটও ছোঁড়া না হয়।
(গ) সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং দেশের পশ্চিম অংশ থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য আমদানি অবিলম্বে বন্ধ করত হবে।
(ঘ) বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন শাখায় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চলবে না এবং সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণজনিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার
নির্দেশ দিতে হবে।।
(ঙ) আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ কেবলমাত্র পুলিশ ও বাঙালি ইপিআর বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। যখনই প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁদের উক্ত কাজে সহায়তা করবেন।
(চ) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
(ছ) অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

যদি সামরিক মোকাবিলা চলতে থাকে এবং আমাদের নিরস্ত্র জনগণের ওপর বুলেট নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে সন্দেহের কোনো অবকাশ না রেখে আমি বলতে চাই যে, সে অবস্থায় কোনো জাতীয় পরিষদই কাজ করতে পারবে না।

আমাদের জনগণ ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা তাদেরকে আর উপনিবেশ অথবা বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবেন না। তারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হবার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেছেন। আমাদের অর্থনীতিকে অবশ্যই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতী জনগণকে অনাহার, রোগ ও বেকারত্ব থেকে বাঁচাতে হবে। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ লোকের পুনর্বাসনের কাজ এখোনো বাকি রয়েছে। যদি শাসকগোষ্ঠী এ সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে মুক্তির জন্যে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাতে জনগণও প্রস্তুত। যে মুক্তির জন্যে অনেক শহীদের রক্ত ঝরেছে এবং যার জন্য বহু লোক আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, জনগণের সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যাবে না। আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনগণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা বীরত্বের সাথে বুলেটের মোকাবিলা করেছেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বাঙালি ও তথাকথিত অবাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দালাল, উস্কানিদাতা ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য আমি আমাদের জনগণ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আবার বলছি যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি লোকই বাঙালি এবং তার শারীরিক নিরাপত্তা, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং যে কোনো মূল্যে তা করতে হবে। আমাদের সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হচ্ছে অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জিত না হয়, আমাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

আগামী এক সপ্তাহের কর্মসূচি :
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে :

(১) খাজনা-ট্যাক্স বর্জন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
(২) সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রোয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোনো কোনো অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে।
(৩) রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয় তাহলে রেলওয়ে শ্রমিকরা সহযোগিতা করবেন না।
(৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে খবর গোপন করতে পারবে না, অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত বাঙালিরা সহযোগিতা করবেন না।
(৫) কেবল স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক টেলিফোন যোগাযোগ চালু
থাকবে।
(৬) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
(৭) ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না।
(৮) প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে।
(9) অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বিশেষে যে কোনো সময় উপরোক্ত ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা হতে পারে।
(১০) প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।

Reference:
দৈনিক পাকিস্তান, ৮ মার্চ ১৯৭১
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আনু মাহমুদ, পৃষ্ঠা ১৩৪-১৪১, প্রকাশকাল ২০১৭, ঢাকা, ন্যাশনাল পাবলিকেশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!