You dont have javascript enabled! Please enable it! 1957.02.11 | আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শেখ মুজিবের বক্তৃতার বিবরণ | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদ
১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭
আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শেখ মুজিবের বক্তৃতার বিবরণ

… আমরা আওয়ামী লীগ থেকে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব পেশ করি। এ-সময় খাদ্য সঙ্কট চরমে উঠে এবং দেশব্যাপী গণ-বিক্ষোভ দেখা দেয়। প্রায় প্রত্যেক জেলা সদরে গ্রামাঞ্চল থেকে ভূখ মিছিল আসতে আরম্ভ করে। রাজধানীর বুকেও ভূখ মিছিল আসতে আরম্ভ করে। দিশেহারা আবু হােসেন মন্ত্রিসভা নিজেদের আত্মরক্ষার আর কোন উপায় নেই বলে পদত্যাগ করে। বুড়ীগঙ্গা নদীর অপর পার জিঞ্জিরা এলাকা থেকে আগত এক ভূখ মিছিলের উপর গুলীবর্ষণ করা হয়। চক বাজারের এই গুলিতে খাদ্যের কাংগাল কঙ্কালসার কয়েক ব্যক্তি-নিহত হয়। এ খবর মুহূর্তে সমগ্র ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং বিপুল জনতা গুলিতে নিহত এক ব্যাক্তির মৃতদেহ নিয়ে বিরাট মিছিল সহকারে চকবাজার হইতে কাচারীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। জনসাধারণের এই বিপদের দিনে আওয়ামীলীগ তাদের কাতারে শামিল হয়। গুলিবর্ষণের খবর প্রাপ্তির অল্পক্ষণ মধ্যেই জনাব আতাউর রহমান খান, আমি, ইয়ার মুহাম্মদ খান, দবির উদ্দিন, আবুল মনসুর সাহেব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। জনতার মিছিল যাতে শান্তিপূর্ণভাবে শহর প্রদক্ষিণ করে সেজন্য আমি ও ইয়ার মুহাম্মদ খান মিছিলের সঙ্গে অগ্রসর হই। জনাব আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমেদ আহত ব্যাক্তিদের শশ্রুষার। ব্যাবস্থার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে গমন করেন। মিছিল সদরঘাটে পৌছলে পুলিশ। আবার গুলিবর্ষণ করে।ওখানেও কয়েক ব্যক্তি গুরুতররূপে আহত হয়। এ সংবাদ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদে ঢাকা শহরে সর্বাত্বক হরতাল প্রতিপালিত হয়। মফঃস্বলেও তার অনুসরণ হতে থাকে।
পূৰ্ব্ব বাংলার শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। বাধ্য হয়ে সরকার জনাব আতাউর রহমান খানকে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করার আহবান করেন। দেশের নিয়মতান্ত্রিক বিরােধীদল হিসেবে শত বিপদও প্রায় অপ্রতিরােধ্য দুর্ভিক্ষ এবং তজ্জন্য শত শত লােকের মৃত্যুর সম্ভাবনা সামনে দেখেও আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটি গভর্ণরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে দীর্ঘ ৯ বৎসর বিরােধীদল হিসেবে অবস্থান করার পর সত্যিকার আওয়ামীলীগ হিসেবে প্রদেশের শাসনকার্য চালাইবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। যদিও আওয়ামীলীগের কাছে মন্ত্রীত্ব কিছুই নয় দেশের নিঃসার্থ সেবাই আদর্শ।
… বলবাে। … কাজেই মন্ত্রিসভার অন্যতম সভ্য হিসাবে, আমার মুখে আমরা যতটুকু করতে পেরেছি তার বিবরণ নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। তাছাড়া এরূপ বিবরণ কতকটা শালীনতা বিরুদ্ধও বটে। মাত্র পাঁচ মাস সময় আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে চার মাস। ব্যয় হয়েছে দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে দেশের জনসাধারণকে বাঁচাবার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যশস্য এনে তার সুষ্ঠু ও দ্রুত বিলিব্যবস্থার কাজে। সকলেই স্বীকার করবেন সকল কাজের উর্ধ্বে ছিল এ-কাজ। আল্লাহর মেহেরবানীতে এবং জনসাধারণের সমর্থন এবং সহকর্মীদের সহযােগিতায় আমাদের মন্ত্রিসভা তাদের এ-গুরুদায়িত্ব প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়েছে। ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ত কিছু কিছু হয়েছে; কিন্তু তা সদিচ্ছার অভাবে নয়, দূরতিক্রম্য বাধা বিপত্তির জন্য। তাছাড়া একথাও আপনারা স্মরণ রাখবেন যে শাসনভার পরিচালনার। জন্য আমাদের কারও কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিতেও কিছুটা সময় লেগেছে। প্রসঙ্গত আর একটি কথার এখানে উল্লেখ করতে হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ। মন্ত্রীসভা গঠন করার অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রে মুসলিম লীগ কৃষক শ্রমিক কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে বিরােধীদলের নেতা হিসেবে তখন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্র মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ করেন। সােহরাওয়ার্দী এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কেন্দ্রে ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জনাব সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভা পূৰ্ব্ব বঙ্গের খাদ্য সংকট সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে অর্থ সাহায্য ছাড়াও তাদের সঙ্গে মনে প্রাণে সর্ব প্রকার সহযােগিতা করেছেন। এজন্য সাহরাওয়ার্দী ও তার মন্ত্রীসভার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এবং তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি এ সময়ের মধ্যে খাদ্য সমস্যার সমাধান ছাড়াও আওয়ামীলীগ মন্ত্রীসভা সৰ্ব্বাপেক্ষা বেশি উল্লেখযােগ্য যে কাজ করেছে তা হলাে, বিপূল ভােটাধিক্যে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের এসেম্বলিতে প্রস্তাব গ্রহণ। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টেও এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে আগামী নির্বাচন যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে হচ্ছে এবং সত্যিকার পাকিস্তানী জাতি সৃষ্টি হওয়ার সূত্রপাত হচ্ছে। ভাইসব এখন ভবিষ্যত সম্পর্কে দুচারটি কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। আগামী মার্চএপ্রিল মাসে সাধারণ নিৰ্বাচন হবে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে। এই পরিষদের জন্য ৪৬৫ জন প্রতিনিধিকে আমাদের মনােনয়ন প্রদান করতে হবে। তাদের বাছাই ছাড়াও দেশের। সৰ্ব্বপ্রথম এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পার্টিকে সাফল্যমণ্ডিত করা যে কি বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ তা আশা করি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। এখন হতে সেজন্য বিপুল উদ্যম নিয়ে কাজে নাবতে হবে। মনে রাখবেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামীলীগ কোথাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করেনি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের পূর্বে পার্টির নির্দেশিত সমস্ত কাজ করা যেসব সময়ে সম্ভবপর হয়ে উঠে না তা আপনারা জ্ঞাত আছেন। কাজেই আওয়ামীলীগকে সাংগঠনিক দিক থেকে আরাে শক্তিশালী ও। দুর্জয় করে তুলতে হবে। জনগণকে আওয়ামীলীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। দিবারাত্রি চালাতে হবে প্রচার। তাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন আনতে হবে পার্টির জন্য। তাদের অভাব-অভিযােগ মন্ত্রিসভার কাছে পেশ করতে হবে আওয়ামীলীগকেই। এক কথায় জনসাধারণের সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের বৈপ্লবিক রূপ বদলানাে চলবে না। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পূর্বে আওয়ামী লীগ যেমন জনসাধারণের সকল আন্দোলনের পুরােধায় রয়েছে এখনও তেমনি পুরােধায় থাকতে হবে তাকে। একমাত্র এই পন্থায় আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক জীবনে জীবিত থাকবে।
ইউনিয়ন, থানা ও মহকুমা আওয়ামীলীগ গুলােকে বর্তমানাপেক্ষাও বেশি সক্রিয় করে তুলতে হবে। যে সব স্থানে আওয়ামীলীগের কমিটি এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি কৰ্ম্মীগণকে যেসব জায়গায় কমিটি গঠনের কাৰ্য্যে করতে হবে আত্মনিয়ােগ। আওয়ামীলীগ গড়তে হবে দেশের সর্বত্র। আমাদের রয়েছে মহান ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে জনহিতকর মহান কর্মসূচী। সে কর্মসূচী জনসাধারণ গ্রহণ করেছে। আমাদের প্রােগ্রামের ডাকে তারা সাড়া দিয়েছেন। আমাদের সাফল্য অনিবার্য্য। শেষ করার পূর্বে যে কথাটির উল্লেখ করতে চাই, তা হলাে আওয়ামীলীগ এখন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। কাজেই প্রতিষ্ঠানে সকল সম্প্রদায়ের লােক যােগদান করতে পারে সেদিকেও কশ্মীদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
উপসংহারে আমি আর সামান্য দুচারটি কথা বলতে চাইঃ আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে আমি আপনাদের সাধারণ সম্পাদকের কাজ করে এসেছি। একাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে। আপনাদের সহায়তায় যথাসাধ্য মােকাবেলা করেছি। কিন্তু শত চেষ্টা ও শত সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে হয়তাে অনেক ব্যাপারে। অনেকক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ গতিকেই আপনারা আমার কাছ থেকে আশা করেছেন ততটুকু পাননি। আপনারা নিজগুণে তা ক্ষমা করে নিয়েছেন। আজ বিদায় নেবার প্রাক্কালে, আমার কাৰ্যকালে আমি আপনাদের সকলের যে অগাধ হে, ভালবাসা পেয়েছি। তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আজ থেকে আবার আমি কোন রকম পদমর্যাদা ব্যাতিরেকে সাধারন একজন কর্মী হিসেবে আওয়ামীলীগের কাজে আত্মনিয়ােগ করতে পারবাে সে আমার আনন্দ। শেষ করার পূর্বে আওয়ামীলীগের ভূতপূৰ্ব্ব সাধারণ সম্পাদক জনাব সামসুল হক সম্পর্কে দুচারটি কথা বলতে চাই। পূৰ্ব্ব বাংলার সবচাইতে বিপদের দিনে তিনি মওলানা ভাসানীর সহকর্মী হিসেবে লীগ সরকারের চণ্ডনীতির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন। দীর্ঘকাল কারাবরণের ফলে তিনি আজ গুরুতর অসুস্থ। বর্তমানে তিনি লাহাের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রয়ােজনবােধে তাকে চিকিৎসার জন্য ইউরােপে পাঠাবার জন্য আমরা জনাব সােহরাওয়ার্দীকে অনুরােধ করেছি। আসুন আমরা সকলে মিলে তার রােগমুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। আমাদের অফিস সম্পাদক জনাব আহমদুল্লাহ সাহেব ছয়মাস পূর্বে দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন তিনি নিজের শরীরের প্রতি দৃকপাত না করে আওয়ামীলীগের অফিস সম্পাদকের …যথেষ্ট দক্ষতা ও যােগ্যতার সঙ্গে করিয়াছেন।
অসমাপ্ত।