You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাপ্তাহিক সৈনিক
১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭
আওয়ামী লীগের মুখপত্রের দৃষ্টিতে ভাসানীর ‘সাংস্কৃতিক লীলা

কাগমারীতে জনাব ভাসানীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক’ সাংস্কৃতিক সম্মেলন সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলিয়াছেন। এই সকল উক্তিকে ‘দুষ্ট লােক ও বিভেদ সৃষ্টিকারীদের প্রচারণা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সরকারী মুখপত্র ‘ইত্তেফাকে ও রাজনৈতিক মঞ্চে মুখ খুলিয়া ফেলিয়াছেন। গত ১১ই ফেব্রুয়ারীর সংখ্যায় ‘মােসাফির’ যাহা লিখিয়াছেন তাহার উপর মন্তব্য করা নিষ্প্রয়ােজন।“আওয়ামী লীগ সম্মেলনের কতকগুলি কাজ আমাদের কাছে ভাল লাগে নাই। অবশ্য এজন্য কে দায়ী, তাহা আমরা জানি না। প্রথমতঃ তােরণ নির্মাণের প্রশ্নে ভারতীয় অতগুলি নেতার নামে তােরণ নির্মাণ, আমাদের কাছে বিষদৃশ্য ঠেকিয়াছে- বিশেষ করিয়া যখন আজ পর্যন্ত ভারতে পাকিস্তানের কোন জাতীয় নেতা, সাহিত্যিক, কবি বা সমাজকর্মীকে কোনরূপ সম্মান প্রদর্শন করা হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ ভারত হইতে জনাব হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে ডেলিগেশন প্রেরণের মধ্যে যে দুষ্ট মনােভাব নিহিত রহিয়াছে, তাহাও আমরা উপেক্ষা করিতে পারি না। হুমায়ুন কবির সাহেব। ফরিদপুরের অধিবাসী এবং পাকিস্তান বিরােধীতায় তাহার ভূমিকা সর্বজনবিদিত। কায়েদে আজম কংগ্রেসের সহিত আপােষ আলােচনায় সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস প্রতিনিধি হিসাবে মওলানা আজাদের সহিত তিনি কখনও আলােচনা করিতে রাজী হন নাই। ভারতে আজ হুমায়ুন কবির অপেক্ষা বহু উচ্চ ধরনের শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসেবী রহিয়াছেন; সে ক্ষেত্রে অন্য কোন যােগ্যতর ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন ভারত কালচারাল মিশন প্রেরণ না করায় আমাদের মনে পাকিস্তান আন্দোলনের কালে ভারতীয় কংগ্রেসী নেতাদের শাে-বয়’ খাড়া করিবার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়াছিল, সেই কথাই স্মরণ হইতেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির খাতিরে আজ পাকিস্তানে সেই সব সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের মন্ত্রীত্বে পর্যন্ত অংশীদার করা হইয়াছে, যারা একদিন পাকিস্তানের বিরােধিতা করিয়াছিলেন, কিন্তু ভারতের যেসব মুসলমান অখণ্ড ভারতের সমর্থন না দিয়া পাকিস্তান দাবীর সমর্থন করিয়াছিলেন, তাঁদের একজনকে কি ভারতীয় কংগ্রেস সরকার কোন রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়াছেন? দেন। নাই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করিবার জন্য মেসার্স হুমায়ুন কবিরদের মত লােকদেরে কংগ্রেস সরকার যত খুশী পুরস্কৃত করিতে পারেন, কিন্তু সেই সকল লােকের নেতৃত্বে পাকিস্তানে কোন মিশন গ্রহণ করা ভারতীয় মুসলমানদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিবার মত। পাকিস্তান সংখ্যালঘুদের যে মর্যাদা দিয়াছে, ভারত তার। সংখ্যালঘুদেরকে সে মর্যাদা দেয় নাই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষ করিয়া লিয়াকত-নেহরু চুক্তির পরও ভারতের উগ্রপন্থীদের কৃপায় ৩৬৫টি সাম্প্রদায়িক দাংগা অনুষ্ঠিত হইয়াছে। কাশ্মীরকে সামরিক শক্তি বলে করায়ত্ত করিয়া রাখিয়াও ভারত আজ লজ্জার মাথা খাইয়া দুনিয়ায় প্রচার করিয়া বেড়াইতেছে যে ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা নীতির (Secularism) জন্যই তারা কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িকতার জিগীর তুলিয়া গণভােট অনুষ্ঠান করিতে দিতে রাজী নহে। ভারতের এই মনােবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে হুমায়ুন কবির সাহেবের নেতৃত্বে কালচারাল মিশন গ্রহণ করিয়া কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্যোক্তারা ভারতীয় ঐ প্রচারের সুযােগ করিয়া দিলেন কিনা, আজ নিবিষ্ট মনে তাঁরা যেন তাহা ভাবিয়া দেখেন। আজ বিশ্বস্বীকৃত নীতি হইল যে দুইটি রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত বা রাজনৈতিক বিরােধ থাকিলেও অর্থনীতি ক্ষেত্রে পরস্পর স্বার্থের ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনা করা যায়। এই ভিত্তিতেই সেদিন পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে। কিন্তু এই চুক্তিকেও ভারত জাতিসংঘের কাশ্মীর ইস্যুতে ব্যবহার করিতে চাহিয়াছে। ভারতীয় প্রতিনিধি মিঃ কৃষ্ণ মেনন কাশ্মীর প্রশ্নকে শিকায় তুলিবার জন্য সেদিন জাতিসংঘে এই বাণিজ্য চুক্তির উল্লেখ করিয়াছিলেন। মিঃ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে প্রেরিত সাংস্কৃতিক মিশনকে ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা প্রমাণ করিতে ব্যবহার করা কিছুই অসম্ভব নয়। তারপর ভারতীয় পত্রিকাগুলিতে মওলানা ভাসানী সাহেবকে আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা প্রমাণ করিবার জন্য যে ধরনের কোশেশ করা হইয়াছে, তদ্বারা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক রূপকে শুধু যে অস্বীকার করা হইয়াছে তাহাই নহে, মওলানা সাহেবকেও গণতান্ত্রিক দুনিয়ার কাছে হেয়প্রতিপন্ন করা হইয়াছে। কলিকাতাস্থ পত্রিকাসমূহে বলা হইয়াছে যে, কোন মন্ত্রীপরিষদ সদস্য বা কাউন্সিলার পূর্ব পাক আওয়ামী লীগের পূর্বতন পররাষ্ট্রনীতির বিরােধিতা করিলে তাহাকে প্রতিষ্ঠান হইতে বহিষ্কার করিবার ক্ষমতা মওলানা ভাসানী সাহেবকে প্রদান করা হইয়াছে। খবরে আরও বলা হইয়াছে যে, স্বয়ং মওলানা সাহেব এই প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন। কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কোন গণতান্ত্রিক নেতা সম্পর্কে এইরূপ খবর প্রকাশ করা হইলে তার যে কতখানি সর্বনাশ করা হয়, অতি-উৎসাহী ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি সেদিকেও নজর দিতে পারে নাই। ভারতীয় সংবাদপত্রের খবর বিশ্বাস। করিতে হইলে ইহায় বিশ্বাস করিতে হয় যে, মওলানা সাহেব স্বয়ং গণতন্ত্রের পথ ছাড়িয়া ডিক্টেটরী ক্ষমতা লাভ করিতে চাহেন। আফসােস, ভারতের একশ্রেণীর নেতা ও সংবাদপত্র আজাদী আন্দোলন কালের ভ্রান্ত নীতি আজও পরিহার করিতে পারেন। নাই। এখনও তারা মনে করেন যে, পাকিস্তানে কোন্দল সৃষ্টি করিয়া বা কাহাকেও শিখণ্ডী দাঁড় করাইয়া তারা পাকিস্তানকে বানচাল করিতে পারেন। … ব্যক্তি কোন্ ছাই, কোন প্রতিষ্ঠানও যদি আজ জাতীয় স্বার্থের ব্যতিক্রম কোন কিছু করে তাহা। হইলে পাকিস্তানের জনসাধারণ একবাক্যে তার বিরােধিতা করিতে জানে। ব্যক্তি অপেক্ষা প্রতিষ্ঠান বড়; প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা দেশ বড়। পাকিস্তানের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক সেটুকু বিচার করিতে জানে। পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী ও জনমতের বিরােধী যে কোন কাজ শহীদ সােহরাওয়ার্দীই করুন, ভাসানীই করুন, ফযলুল হকই করুন, আওয়ামী লীগই করুক বা মুসলিম লীগই করুক, যে কেহ করুকপাকিস্তানের নাগরিকরা তাহা এক মুহুর্তে ব্যর্থ করিয়া দিতে পারে। কোন মন্ত্রিসভাই মাথা বাধাইয়া আসে নাই। মন্ত্রিসভা আসে, আর যায়। আওয়ামী লীগ দেশের মঙ্গল বিধানে সমর্থ হইলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকুক, নতুবা সরিয়া দাঁড়াউক; শুধু মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠাই দলের বা জাতির লক্ষ্য নয়। আজাদী সংরক্ষণই জাতির নিকট প্রাণাপেক্ষা প্রিয় প্রশ্ন।
আকাশচারী, পাকিস্তান বিদ্বেষীরা মনে করে যে, যেহেতু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য নিয়া দ্বন্দ্ব চলিয়াছে সেইহেতু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে এবং একদিন টপ করিয়া রসগােল্লার মত ভারতের গ্রাসের মধ্যে পড়িবে। ভাই ভাই বিরােধ থাকে, পরস্পরের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, কিন্তু ধ্বংস হইবার দুবুদ্ধি না থাকিলে কেহ কাহারও নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হয় না। পাকিস্তানে আজ ভেদ-বৈষম্য রহিয়াছে একদল লােক পাকিস্তানকে শােষণ করিতেছে, এই শােষকদের মধ্যে সংখ্যার তারতম্য থাকিতে পারে, কিন্তু এই
(অসমাপ্ত)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!