সংবাদ
২৭শে জানুয়ারি ১৯৫৭
কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাকায় পূর্ণ দিবস হরতাল প্রতিপালিত
শান্তিপূর্ণভাবে দিবস উদযাপিত
পল্টনের জনসভায় অবিলম্বে নিরপেক্ষ গণভােটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দাবি
স্টাফ রিপাের্টার
রাজধানীর ছাত্র-জনতা গতকল্য (শনিবার) কাশ্মীরের ভারতভূক্তির বজ্রকঠোর কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছে। “কাশ্মীর দিবস” উপলক্ষে ঢাকায় যানবাহন ও দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদের আহ্বানে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ ধর্মঘট পালন করে। এই দিবস উপলক্ষে সরকারী অফিস-আদালতের অধিকাংশ কর্মচারী কার্যে যােগদান করেন নাই।
অপরাহ্নে পলটন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবে “ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নীতির” তীব্র নিন্দা করিয়া কাশ্মীরে অবিলম্বে অবাধ ও নিরপেক্ষ গণভােটের দাবি করা হইয়াছে। উক্ত সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, পাকিস্তান কাশ্মীরকে গ্রাস করিতে চায় না। আমরা চাই কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণভােট। দুপুর বারটার সঙ্গে সঙ্গে কালাে ব্যাজ ও কালাে পতাকা সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীগণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়। শােভাযাত্রা করিয়া ছাত্রগণ ইস্কাটন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের বাসভবনের সম্মুখে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের কাৰ্য্য..ভুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শােভাযাত্রীগণ কাশ্মীরে গণভােট চাই’ নিরপেক্ষ, ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হউক’ ইত্যাদি শ্লোগানে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। তাহাদের আটজন নেতা ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের স্ত্রী মৈত্রেয়র সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া কাশ্মীরে ভারতীয় জুলুম বন্ধ এবং উক্ত রাজ্যের ভারত ভুক্তির … প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়াছেন। ছাত্রদের এই প্রতিবাদ শ্ৰী মৈত্র ভারত সরকারকে জানাইবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। ছাত্রগণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহেরুর একটি কুশপুত্তলিকা ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসগৃহের সম্মুখে দাহ করিয়াছে। ছাত্রদের শােভাযাত্রাটি এবং কাশ্মীর আজাদ কমিটি ইসলাম লীগ ও মােজাহের .. প্রতিষ্ঠানসমূহ বেলা তিনটায় মিছিল করিয়া পল্টন ময়দানে জমায়েত হয়।পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রীদল, কংগ্রেস, মুসলিমলীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, কাশ্মীর সত্যাগ্রহ পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিভিন্ন হল ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণ কাশ্মীরীদিগের আত্মনিন্ত্রণাদি এবং উক্ত দেশে অবাধ গণভােট দাবি করিয়া বক্তৃতা করেন। এই সভায় পুরােহিত্য করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদের আহবায়ক জনাব আবদুল মমিন তালুকদার। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল টিকাটুলিস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের সম্মুখে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন স্লোগান সহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কোন প্রকার গােলযােগ সৃষ্টি হয় নাই। ভারতীয় হাই কমিশনারের সম্মুখে কড়া পুলিশ মােতায়েন করা হয়েছিল। সভার পর মিছিলের অগ্রভাগে গাড়িতে অশােভনভাবে জনৈক এক ব্যক্তিকে শ্ৰী নেহেরু বানাইয়া পাদুকাঘাত করতে করতে সদরঘাট পর্যন্ত লইয়া যাওয়া হয়। নেহেরুর অপর একটি বিরাটকায় কাগজ পােড়ানাে হইয়াছে।
বক্তৃতা
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান জনসভায় ঘােষণা করেন কাশ্মীরে নিরপেক্ষ গণভােটই আমাদের .. ভারত বলপূৰ্ব্বক কাশ্মীর দখল করিয়া এক প্রকার গণতন্ত্র ও ন্যায়নীতি অবমাননা করিয়াছে। তদুপরি জাতিসঙ্ঘে..প্রথম গিয়াছিল। পাকিস্তানই কেবলমাত্র জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবকে মানিয়া লইতে স্বীকৃত হইয়াছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারত অদ্যাবধি জাতিসঙ্রে সিদ্ধান্ত কার্যকর করিতে হয় নাই। এই জন্যই কৌশল করিয়া ভারত কাশ্মীরে গণভােট… করিয়া রাখিতেছে। শেখ মুজিব ভারতের শান্তিকামী জনগণের নিকট আবেদন করিয়া বলেন, আপনারা শ্রী নেহেরুকে কাশ্মীরে শান্তিরক্ষার জন্য নিরপেক্ষ গণভােট গ্রহণের উদ্দেশ্যে চাপ দিন। আমরা পাকিস্তানের জনসাধারণ ভারতের সঙ্গে সর্বপ্রকার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রাখিয়া বাঁচিতে চাই। রাজ্য গ্রাস করার কোন প্রকার অভিলাষ পাকিস্তানের নাই। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন অত্যাচারী শক্তিই গণতান্ত্রিক জনমতের বিরুদ্ধে বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। পণ্ডিতজির নিকট আমার আবেদন কাশ্মীরে স্বাধীন গণভােট করিতে দেওয়া হউক, এই দেশের নেতা আবদুল্লাহকে বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হউক। কাশ্মীরের অত্মনিয়ন্ত্ৰাধিকার দাবি শুধু সাড়ে সাত কোটি পাকিস্তানীরই নয়, দুনিয়ার। শান্তিকামী প্রত্যেকটি মানুষের ন্যায়নিষ্ঠ দাবি। আওয়ামী লীগ নেতা বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে সর্বপ্রকার প্রতিবাদ জ্ঞাপনের অনুরােধ করেন এবং বলেন যে, বিক্ষোভের সময় সর্বপ্রকার কূটনৈতিক সৌজন্য রক্ষা করিয়া চলিবেন। তিনি বলেন, জনাব সােহরাওয়ার্দীর বলিষ্ঠ নীতিই আজ আমাদের কাশ্মীর সমস্যার প্রশ্নে এতদূর অগ্রগামী করিয়াছে। পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের নেতা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার সদস্য জনাব মাহমুদ আলী কাশ্মীরে নিরপেক্ষ গণভােটের দাবি করেন। তিনি বলেন, ভারতের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ একসময় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করিয়াছিলেন। কিন্তু কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার অধিকার আজ ভারত স্বীকার করিতেছে না। দুনিয়া হইতে পরাধীনতার সর্বশেষ চিহ্নটুকু নিশ্চিহ্ন করার সংগ্রামই পাকিস্তানের শপথ। ভারতের ন্যায় পাকিস্তান কাশ্মীরকে গ্রাস করার কোন প্রকার অভিলাষ রাখে না। কাশ্মীরের স্বাধীনতার সংগ্রামে পাকিস্তান আজ আগাইয়া না আসিলে হয়তাে একদিন পাকিস্তানের উপরও জুলুম আসিতে পারে। তিনি বলেন, আমরা সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে বদ্ধপরিকর। কিন্তু সৰ্ব্বদা লক্ষ্য রাখিতে হইবে যেন বিক্ষোভ প্রদর্শনে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা প্রকাশ না পায়- আমাদের প্রমাণ করিতে হইবে যেন আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। মুসলিম লীগের প্রতিনিধি জনাব মাহমুদুল হক সভায় বলেন, কাশ্মীরের এই সংগ্রামে পাকিস্তানের বিষয়ে জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রাপ্য। সােহরাওয়ার্দীর কাৰ্য্যের প্রশংসা করিয়া তিনি বলেন, সােহরাওয়ার্দী দুনিয়ার জনমতকে পাকিস্তানের পক্ষে আনিতে সমর্থ হইয়াছে। সেইজন্যই আজ প্রধানমন্ত্রীর হস্তকে এই ব্যাপারে সকলকে দৃঢ় করা উচিত।
প্রাদেশিক কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারন সম্পাদক বলে,পাকিস্তানের জনগণ শান্তি ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেইজন্যই আমরা পাকিস্তানের জনগণের জন্য শান্তি কামনা করি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সহ সভাপতি জনাব সামসুল হক বলেন, বকশী সরকারের দাবিকে জাতিসঙ্ স্বীকার করে নাই। তবুও ভারত কাশ্মীর দখল করিবার সকল প্রকার চেষ্টা করিতেছে। দুনিয়ার মানুষ কাশ্মীরে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ বরদাশত করিবে না! আমরা আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়া কাশ্মীরে সাম্রাজ্যবাদী হামলা প্রতিরােধ করিব। ইকবাল হলের সহ-সভাপতি জনাব দেওয়ান সাইফুল আলম বলেন যে; কাশ্মীরের আন্দোলনে সংখ্যালঘুদের উপর যেন কোন অন্যায় অত্যাচার না হয়। পাকিস্তানের হিন্দু ও মুসলমান একসঙ্গে কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সংগ্রাম করিব। কাশ্মীর সত্যাগ্রহ পার্টির সদর জনাব ফজলুস সালাম বলেন, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি মানুষ কাশ্মীরকে পরাধীনতার কবল হইতে রক্ষা করিতে বদ্ধপরিকর। সভার সভাপতি জনাব আব্দুল মমিন তালুকদার সকলকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইতে আহবান জানাইয়াছেন।
সভায় ফজলুল হক হলের সহসভাপতি জনাব আবদুল মমিন, যুবলীগের সহসভাপতি শ্রী নিতাই গাঙ্গুলী, ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক শাহ আজিজ, ছাত্রলীগের জনাব নুরুল ইসলাম, ল এসােসিয়েশনের সম্পাদক জনাব আব্দুল হক, ঢাকা হল সম্পাদক শ্ৰী নিৰ্ম্মল কুমার সেন, ঢাকা কলেজের আব্দুল হামিদ প্রমুখ ছাত্রনেতা কাশ্মীরের স্বাধীন মতামত জ্ঞাপনের অধিকার দানের দাবিতে বক্তৃতা করেন।