You dont have javascript enabled! Please enable it! 1956.11.10 | আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের জঘন্য মিথ্যা প্রচারণা | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
১০ই নভেম্বর ১৯৫৬
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের জঘন্য মিথ্যা প্রচারণা
মানজারে আলমের সাম্প্রতিক বিবৃতির প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান

পাকিস্তান মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী জনাব মানজারে আলম আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে করাচীতে যে মিথ্যা প্রচার চালান তাহার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবুর এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণকে খাদ্য দানের জন্য স্থাপিত লঙ্গরখানাসমূহ আওয়ামী লীগ কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহৃত হইতেছে এবং যাহারা যুক্ত নির্বাচনের বিরােধী তাহাদিগকে এই সকল লঙ্গরখানা হইতে খাদ্য দেওয়া হইতেছে না বলিয়া পাকিস্তান মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী জনাব মানজারে আলম কয়েক দিন পূর্বে করাচী প্রত্যাবর্তন করিয়া এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করিয়াছেন বলিয়া এক শ্রেণীর সংবাদপত্রে যে খবর প্রকাশিত হইয়াছে তপ্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। বিদ্বেষপ্রসূত এই জাজ্বল্যমান মিথ্যা বিবৃতির প্রতিবাদ করার প্রয়ােজন পূর্ব পাকিস্তানে নাই। কারণ এখানকার জনসাধারণ প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ অবহিত রহিয়াছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই মুসলিম লীগ চাই যে মিথ্যা গুজব রটাইয়াছেন, তাহাতে পশ্চিম পাকিস্তানের অসতর্ক ও অনবহিত জনসাধারণের ভুলপথে পরিচালিত হইবার আশঙ্কা থাকায় ইহার প্রতিবাদ করা দরকার।
এই গুজব রটনাকারী নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন যে, ঢাকা অপেক্ষা করাচীর অধিকতর অনুকূল পরিবেশেই কেবল তিনি এই ধরনের সাফল্যবান মিথ্যা ও ক্ষতিকর বিবৃতি দিতে পারেন। কারণ তিনি ভাল করিয়াই জানেন যে, তিনি যদি পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও এই ধরনের বিবৃতি দিতেন তাহা হইলে জনসাধারণই ইহার এমন জবাব দিত যাহাতে তিনি হতভম্ব হইয়া যাইতেন। আমাদের দেশের যে সকল লােক লঙ্গরখানার প্রকৃত কার্য পদ্ধতি ও উহার গঠন প্রণালী সম্পর্কে অবহিত নহেন, তাহাদের সুবিধার্থে আমি নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করিতেছিঃ(১) বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক সহস্র লঙ্গরখানা পরিচালিত হইতেছে। সকল মত ও পথের অনুসারীদের সমন্বয়ে বর্তমান সরকার কর্তৃক পুনর্গঠিত খাদ্য ও সাহায্যদান কমিটি প্রত্যেক ইউনিয়নে সরকারী কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে এই সকল লঙ্গরখানা পরিচালন করিতেছে। (২) সরকার প্রত্যহ প্রত্যেকটি লঙ্গরখানায় বিনামূল্যে দুই মন হইতে তদূর্পে চাউল সরবরাহ করিতেছেন। (৩) স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত চাঁদা উঠাইয়া লঙ্গরখানা পরিচালনের ব্যাপারে আকস্মিক ব্যয় নির্বাহ করা হয়। (৪) যে সকল স্থানে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত চাদা পাওয়া যায় না সেই সকল স্থানে সরকার এই সকল আকস্মিক ব্যয় নির্বাহ করিয়া থাকেন। এই উদ্দেশ্যে সরকার এ পর্যন্ত ৮০ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছেন।
সুতরাং ইহা হইতে প্রমাণিত হইবে যে সরকার যখন চাউল সরবরাহ করিতেছেন তখন জনসাধারণ দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থের কথা চিন্তা না করিয়া মানবতার সেবায় অনুপ্রাণিত হইয়া স্বেচ্ছায় লঙ্গরখানাগুলি পরিচালনা করিতেছে। এই সকল লঙ্গরখানা অফিসারদের দ্বারা পরিচালনের ইচ্ছা করা হইলেও তাহা সম্ভব হইত না। কারণ এত বেশী সরকারী অফিসার পাওয়া যায় না। লঙ্গরখানায় খাদ্য বিতরণের ভার স্থানীয় কর্মীদের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে এবং এই সকল কর্মী রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হইয়া মানবতার সেবায় আত্মনিয়ােগ করিয়াছে। এই সকল কর্মী গ্রহণের সময় কোন প্রকার রাজনৈতিক বিস্তার বিবেচনা করা হয় নাই।
সরকার খাদ্য ও সাহায্য কমিটিগুলির দ্বার সকল শ্রেণীর রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের জন্য মুক্ত করিয়া দেওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগগণ তাহাদের ঐতিহ্যে অটল থাকিয়া লঙ্গরখানা পরিচালনের ব্যাপারে এ-পর্যন্ত হীন ভূমিকাই গ্রহণ করিয়াছেন। একথা শুনিয়া জনসাধারণ দুঃখিত হইবেন যে, কতিপয় স্থানে মুসলিম লীগারগণ লঙ্গরখানা খােলার ঘাের বিরােধিতা করিয়া গৃহীত প্রস্তাবে এইরূপ অশ্রুতপূর্ব যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন যে, লঙ্গরখানা খােলা হইলে জনসাধারণ স্থানীয় পরিছন্নতা বিনষ্ট করিবে। ইহা অপেক্ষা অদ্ভুত যুক্তি আর কিছু হইতে পারে? যেখানে জনগণের জীবনমৃত্যুর প্রশ্ন, সেখানে কিছু সংখ্যক মুসলিম লীগার নিজেদের এলাকার পরিচ্ছন্নতা লইয়া উদ্বিগ্ন।
এক্ষণে জনাব মানজারে আলম যদি নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে তাঁহার দলীয় কোন লােক দেখিতে না পান, তাহা হইলে তাহাদের নিজেদিগকে অথবা নিজেদের দলকে দায়ী করা উচিত। এদৃশ্য দেখিয়া করুণার উদ্রেক হয় যে, জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগারগণ নিজেদের রাজনৈতিক আশা-আকাংখা পূরণের জন্য দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র পীড়িত জনগণকে ব্যবহারের চেষ্টা করিতেছে। লঙ্গরখানায় যে সকল স্বেচ্ছাসেবক মানবতার সেবায় আত্মনিয়ােগ করিয়াছেন তাহাদের সম্পর্কে জনাব মানজারে আলমের এই হীন মন্তব্য ঘৃণার সহিত বর্জন করা উচিত।”