You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৬
মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘু সদস্য গ্রহণ করায় পূর্বর্তন শাসক মহলে উষ্মা
জনৈক সদস্যের প্রতি কটাক্ষের ফলে মঙ্গলবারে পরিষদে তুমুল হৈ চৈ
সরকার পক্ষ হইতে দ্বিতীয় দিবসে ৭টি বিল পেশ

স্টাফ রিপাের্টার
গতকল্য (মঙ্গলবার) বৈকালে পুনরায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আরম্ভ হয় এবং একঘণ্টাকাল স্থায়ী হয়। এই অধিবেশনে প্রাক্তন ‘যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় অন্যতম পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব আবদুর রব (বিরােধীদল) আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু মন্ত্রী গ্রহণে আপত্তি এবং সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ ‘পাকিস্তান-বিরােধী ছিলেন বলিয়া অভিযােগ উত্থাপন করিলে পরিষদে তুমুল হট্টগােল ও হৈ চৈ আরম্ভ হয়।এই সময় সরকার ও বিরােধীদলের সদস্যদের মধ্যে কথা কাটাকাটি আরম্ভ হয়। জনাব রব প্রাদেশিক মন্ত্রী শ্রী মনােরঞ্জন ধরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযােগ উত্থাপন করিলে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রী ধর উহার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। জনাব শেখ মুজিবুর রহমান (সরকার পক্ষ) বলেন, যুক্তফ্রন্ট দল ক্ষমতাসীন থাকাকালীন ‘যুক্তফ্রন্ট সরকারের একটি কার্যও ইসলামসম্মত হয় নাই। বরং তাহাদের প্রতিটি কার্যক্রম ইসলাম ও গণতন্ত্রবিরােধী ছিল। শ্রী ধর বলেন, বিরােধীদলের হতাশ সদস্যরা এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পিছনের বেঞ্চ হইতে তারস্বরে চীৎকার করাকেই একমাত্র সম্বল করিয়াছে ও ব্যক্তিগত কুৎসা প্রচারে লিপ্ত হইয়াছে। শ্রী ধর আরও বলেন, ইসলাম ও গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি তিনি পূর্ণ মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল; কিন্তু বিরােধীদলের এই সকল সদস্যের ভূমিকা দৃষ্টে লজ্জায় মাথা হেট হইয়া যায়। ইহার পর সরকার ও বিরােধী উভয় পক্ষ হইতে তুমুল চীৎকার ও টেবিল চাপড়ানি শুরু হয়। এই সময় মওলানা আতহার আলী (বিরােধীদল) কিছু বলিতে আরম্ভ করিলে সরকার পক্ষীয় সদস্যদের তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনির দরুন মওলানা সাহেবের কণ্ঠস্বর তলাইয়া যায়। এই সময়ে মওলানা আতহার আলী চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠেন, “ইহারা দোজখবাসী হইবে।’ প্রেস গ্যালারী হইতে অতঃপর তাহার কণ্ঠস্বর আর শােনা সম্ভব হয় নাই। গতকল্য পরিষদের অধিবেশন আরম্ভ হইলে সর্বপ্রথম একমাত্র বৌদ্ধ প্রতিনিধি লাহিড়ী গ্রুপের শ্রী সুধাংশু বিমল বড়ুয়া (বিরােধীদল) একটি মূলবতী প্রস্তাব উত্থাপন করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। শ্রী বড়য়া তাঁহার মূলতবী প্রস্তাবে চট্টগ্রাম জেলার সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষায় সরকারের অসামর্থ সম্পর্কে আলােচনার দাবী জানান। শ্রী বড়য়ার প্রস্তাব আইনগত কারণে বাতিল হইয়া যায়। অতঃপর জনাব আবদুর রব সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ এবং মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিলে পরিষদের হৈ চৈ আরম্ভ হয় এবং সরকার পক্ষ হইতে কতিপয় সদস্য ইহার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং প্রাক্তন ‘যুক্তফ্রন্ট সরকারের কার্যকলাপ ইসলাম বিরােধী ছিল বলিয়া বিরােধীদলের মারাত্মক সমালােচনা করেন।
জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী রিলিজিয়াস লীডার্স’ পুস্তক সম্পর্কে আলােচনার জন্য অপর এক মূলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তুমূল হৈ চৈ-এর পর মাননীয় স্পীকার এই মূলতবী প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনার জন্য ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাত ঘটিকায় দিন ধার্য করেন।
ইহার পর পুনরায় জনাব আবদুর রব (বিরােধী পক্ষ) সংখ্যালঘু মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তাহার অভিযােগের জওয়াব দাবী করিলে পুনরায় পরিষদে হট্টগােলের সৃষ্টি হয়। এই সময় শ্রী মনােরঞ্জন ধর উঠিয়া বিরােধীদলের প্রতি লক্ষ্য করিয়া উচ্চস্বরে বলেন, কার্যকলাপের দিক হইতে তুলনামূলকভাবে তিনি বিরােধীদলীয় সদস্যদের অপেক্ষা অধিকতর ইসলামপন্থী। শ্রী ধর বলেন, যাঁহারা আজ বিরােধী দলে রহিয়াছেন, ইসলামের প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধা নাই বলিলেই হয়। কারণ ইহারা ক্ষমতায় থাকাকালীন ইসলামের পবিত্র নামে বহু ইসলাম-বিরােধী কার্য করিয়াছেন। তিনি আরও বলেন, ইসলাম জনগণের কল্যাণ বিধানের নির্দেশ দিয়াছে। কিন্তু আজ যাহারা বিরােধীদলে রহিয়াছেন তাহারা ক্ষমতাসীন থাকা কালে জনগণের জন্য কি করিয়াছেন? শ্রী ধর বিরােধীদলীয় সদস্যদের কার্যকলাপের মারাত্মক সমালােচনা করিয়া পরিষদের কার্যবিবরণী হইতে’বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি উঠাইয়া দেওয়ার দাবী জানান। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে ইতিপূর্বে বিরােধীদলীয় জনৈক সদস্য। বক্তৃতাকালে শ্রী ধরকে বিশ্বাসঘাতক বলিয়া অভিহিত করেন। অতঃপর শেখ মুজিবর রহমান বিরােধীদলীয় সদস্যদের উদ্দেশ্য করিয়া বলেন,“এই সকল সদস্য আবার নিজেদেরকে মুসলিম বলিয়া দাবী করেন। অথচ ইহারাই যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তখন লক্ষ লক্ষ লােককে অনাহারে রাখিয়াছিলেন।” তিনি আরাে বলেন,যাহারা আজ সংখ্যালঘু মন্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতক বলিয়া অভিহিত করিতেছেন ,তাহারা নিজেরাই ইসলাম বিরােধী কার্যকলাপের দায়ে দুষ্ট। এমনকি ভারতীয় ব্যাংকে ইহাদের অনেকেরই একাউন্ট রহিয়াছে,ইহা তিনি প্রমাণও করিয়া দিতে পারেন। অতঃপর আসরের নামাজের জন্য পরিষদের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। আসরের নামাজের পর পরিষদের অধিবেশন শুরু হইলে জনাব বােকাইনগরী স্পীকারকে জিজ্ঞাসা করেন, পূর্বদিন আসন গ্রহণের পূর্বে মাথা নিচু করিয়া তিনি (স্পীকার) সদস্যদের অভিবাদন করায় তিনি যে আপত্তি করিয়াছিলেন সে সম্বন্ধে তিনি (স্পীকার) কি ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে চাহেন। তাহার আপত্তির কারণ এই যে, উহা ইসলামী রীতি বিরােধী। ইহার উত্তরে স্পীকার বলেন, সদস্যগণ যদি চাহেন তবে তিনি তাঁহাদের “ আসলামাে আলাইকুম” বলিয়াই অভিবাদন করিবেন।
সাতটি বিলের আলােচনা
অতঃপর পরিষদের বিধান সংক্রান্ত বিষয়ে আলােচনা শুরু হয়। গতকল্য পরিষদের সাতটি বিল পেশ করা হয়। আসরের নামাজের পর ঐগুলির আলােচনা শুরু হয়। অধিকাংশ বিলে বর্ণিত বিধানসমূহ অর্ডিন্যান্সের আকারে পূর্ব হইতেই বলবৎ রহিয়াছে। এই অর্ডিন্যান্সগুলির ধারাসমূহ বিধিসঙ্গত করিয়া তােলার উদ্দেশ্যে উল্লিখিত বিলগুলি পেশ করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান তিনটি বিল পেশ করেন। উহার একটি হইতেছে ১৯৫৬ সালের পূর্ব পাকিস্তান খাদ্য (বিশেষ আদালত) বিল। এই বিলে প্রাদেশিক খাদ্য (বিশেষ আদালত) অর্ডিন্যান্সের ধারাসমূহ বিধিবদ্ধ করা এবং খাদ্য সম্পর্কিত অপরাধের মামলার বিচারের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত সমূহকে ক্ষমতা দানের কথা বলা হইয়াছে। দ্বিতীয়টি হইতেছে পূর্ব পাকিস্তান খাদ্য চলাচল ও বণ্টন সম্পর্কিত বিল। সামরিক ম্যাজিষ্ট্রেটগণ কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাদেশসমূহ এই বিল অনুসারে সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে বাতিল হইবে না। তৃতীয়টি হইতেছে পূর্ব পাকিস্তান সংশােধিত পুলিশ বিল। এই বিলে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন সংশােধনের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশ ইনস্পেক্টরদের গেজেটেড অফিসারের মর্যাদাদানের ব্যবস্থা হওয়ার ফলেই উক্ত আইন সংশােধন করার প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। শিক্ষামন্ত্রী জনাব মাহমুদ আলী পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা (সংশােধিত) বিল এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (সংশােধিত) বিল পেশ করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ বিল পেশ করেন। এই বিলে যে সকল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ প্রয়ােজন অপেক্ষা কম, সেগুলির সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা রহিয়াছে। ঔষধপত্র ,বস্ত্র, যন্ত্রপাতির খুচরা অংশ, নিউজপ্রিন্ট প্রভৃতি ইহার আওতায় পড়িবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!