You dont have javascript enabled! Please enable it!

অবিলম্বে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে

বাংলাদেশের জাতীয় অভ্যুত্থান ভারতের জনমতকে যে কী প্রবলভাবে উদ্বুেদ্ধ করেছে তার জাতীয় প্রতিফল ঘটেছে ভারতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত সবসম্মত ঐতিহাসিক প্রস্তাব। সমগ্র প্রস্তাবকে যথার্থভাবে কার্যকরী করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী সরকারকে আশু স্বীকৃতি দিয়ে। কিন্তু ৭ই মে বিরােধী দলের বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এরূপ স্বীকৃতিদানে অক্ষমতা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সমগ্র বিরােধী পক্ষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই মত প্রকাশ করেছে যে সংসদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কার্যকরী সাহায্য দেওয়ার জন্য অবিলম্বে এই দেশের স্বীকৃতিদান ভারত সরকারের পক্ষে এক অপরিহার্য জাতীয় কর্তব্য।
সরকার পক্ষ মনে করেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে এখনও যথাযােগ্য সময় আসে নি এবং এরূপ স্বীকৃতিদান বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সহায়কও হবে না। পক্ষান্তরে বিরােধী পক্ষ প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে প্রায় ঐক্যবদ্ধভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছে যে, বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতিদান একান্ত আবশ্যক এবং এরূপ স্বীকৃতিদানের পন্থায়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কার্যকর সহায়তা দিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই সংগ্রামকে সম্পূর্ণ করা সম্ভব।
শুধু বিরােধী পক্ষই নয়, বহু রাজ্যের বিধানসভা, ভারতের অগণিত গণ-প্রতিষ্ঠিত নেতা বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের দাবী জানিয়েছেন। এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সরকারি নীতি শুধু অস্পষ্ট অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অযৌক্তিকই নয় গণতান্ত্রিক দিক দিয়েও সরকার আজ ভারতের জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন। কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এখন সে দেশের পক্ষে সহায়ক নয়, তারও যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ প্রকাশ্যে বা নেতৃবর্গের বৈঠকে, ভারত সরকার উপস্থিত করতে সক্ষম হন নি। অথচ, বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী, প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের সঙ্গঠিত জাতীয় সরকার সর্বসম্মতভাবে শুধু ভারত সরকারের কাছেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন তাদের সরকারকে আশু স্বীকৃতিদানের জন্যে।
তবু বিশ্বের ছােট-বড় প্রতিটি রাষ্ট্র আজ বাংলাদেশের প্রশ্নে এরূপ নীরব ও নিষ্ক্রিয় কেন? একথা বহুবার নগ্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বের কোন রাষ্ট্রেরই আজ আন্তর্জাতিক স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র রক্ষার দিকে দৃষ্টি নেই বড় রাষ্ট্রগুলি তাে বটেই, ছােট রাষ্ট্রগুলিও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণ করে সম্পূর্ণরূপে জাতীয় স্বার্থের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিতে। তা ছাড়া বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই চায় না যে পাক-ভারত সমস্যার সমাধান হােক এবং তার ফলে ভারত একটি শক্তিশালী ও প্রধান রাষ্ট্ররূপে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হােক, বরং পাকভারতের পারস্পারিক দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে সব কয়টি বৃহৎ রাষ্ট্রকেই ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য সদা-সচেষ্ট হতে দেখা গিয়েছে।
একথা আজ সুস্পষ্ট যে রুশ, মার্কিন, বৃটেন বা ফ্রান্স পাকিস্তানের বিখণ্ডন চায় না, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় এই রাষ্ট্রগুলি উদগ্রীব তাই, এই রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের জাতীয় অভ্যুত্থানকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে রাজী নয়। সে জন্যেই পাক বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবিক অধিকারের প্রশ্নটি বিরত করতে পর্যন্ত এই রাষ্ট্রগুলি রাজী নয়। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার উদ্দেশ্যেই রাশিয়া ও বৃটেন বাংলাদেশেল স্বাধিকারের একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি শিথিল কনফেডারেশন গঠন করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা। শােনা যাচ্ছে যে পিন্ডিশাহীও এই প্রস্তাবে রাজী এবং এরূপ প্রচেষ্টায় রুশ উদ্যম গ্রহণেও অসম্ভব নয়।
রুশ-মার্কিন-বৃটেন—এই রাষ্ট্রয় এই ঘটনাকে স্বীকার করতে রাজী নয়। যে বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রশ্নে রাজনৈতিক রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশে সার্বভৌম সত্তার অধিকারী জনসাধারণই করে দিয়েছে। ৯৯-৬ শতাংশ গণভােটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিজেদের সার্বভৌম স্বাধীনতা ঘােষণা করে একটি নিজস্ব প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করেছে। বাংলাদেশের সমগ্র জনতা এই সরকারের প্রতি কিরূপ সক্রিয় আনুগত্য। জ্ঞাপন করেছে বাঙ্গালীর বর্তমান সামগ্রিক গণ-অভ্যুত্থান তার সুস্পষ্ট ও তাথ্যিক স্বাক্ষর। কিন্তু জাতীয় স্বার্থান্ধ আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগােষ্ঠীর কাছে এই প্রমাণ ও বাস্তব ঘটনার কোন মূল্য নেই।
বাংলাদেশ সার্বভৌমিকতার যে শর্তগুলি পূরণ করেছে তার চেয়ে অনেক কম শর্ত পূর্ণ করেও বিশ্বর বহু বিদ্রোহী জাতি বহু বিশ্বেররাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব নাম, নিজস্ব পতাকা নিজস্ব জাতীয় সংগীত এবং স্বদেশের জাতীয় ভাষার প্রবর্তন ছাড়াও গণভােটে নির্বাচিত প্রায় সমগ্য প্রতিনিধির সমর্থন, বে-সরকারি ও বাঙ্গালী সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর আনুগত্যলাভ এবং এই দেশের মুক্ত অঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা—এই শর্তগুলি বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তার স্বীকৃতির পক্ষে শুধু যথার্থই নয়—পর্যাপ্তও বটে। তাই সার্বভৌমিকতার শর্ত পূর্তির প্রশ্ন ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিশেষ কোন যুক্তিযুক্ত বাধা নেই। রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামান্য শর্ত পূরণের ক্ষেত্রেও তার অনেক নজীর রয়েছে আন্তর্জাতিক ইতিহাসে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটবে কিনা এবং পরবর্তী অধ্যায়ে এই সংঘর্ষ ভারত ও পিন্ডি-পিকিংচক্রের প্রত্যক্ষ সামরিক দ্বন্দ্বে পরিণত হবে কিনা—সেই প্রশ্নের বাস্তব বিশ্লেষণের আগে একথাটি বিচার করে দেখা প্রয়ােজন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থ কতখানি জড়িত।
একথা আজ পরিষ্কার যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দায়িত্ব শুধু এই দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি আদলনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের ভাগ্যের সঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক,রাজনৈতিক এবং দেশরক্ষার ভবিষ্যৎ সমস্যাও ওতপ্রােতভাবে জড়িত। শুধু পূর্বাঞ্চল ভারতের স্বার্থেই নয় সমগ্র ভারতের ভবিষ্যৎ প্রগতির জন্যও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক-নতুন দিগন্ত উন্মােচন করে দিয়েছে।
একথা বিশ্লেষণের আজ আর প্রয়ােজন নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক সংগঠন এবং পিন্ডি জংলী শাসনের স্থায়ীত্ব বাংলাদেশের শাসন ও শােষনের উপরে একান্তভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বিচ্ছিন্ন হলে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক, সামরিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির উপরে যে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে এবং তার পরিণামে পাকিস্তানে যে অনিবার্য ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তার গতিও হবে সুদূর প্রসারী দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষ ভারত ভাগের পরেও বিচ্ছিন্ন ভূ-খণ্ডে জনজীবনকে মমান্তিকভাবে বিষাক্ত করে রেখেছে। লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশুর অশ্রুজলেও এই বিষের নিত্য স্বাক্ষর নিশ্চিহ্ন হয় নি। বিধাতার এক মহান আশীর্বাদরূপে বাংলাদেশে যে নতুন জাতীয়তাবাদের আহ্বান দিয়েছে সেই ঐতিহাসিক ডাক সফল ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রাণক্ষয়ী বিষের প্রকোপ থেকে মুক্ত হবে।
বাংলাদেশের স্বদেশ বিতারিত গৃহচ্যুতরা অধিকাংশই হিন্দু সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে এদের সংখ্যা এক কোটির মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এখনও এদের পরিচয় বাঙ্গালীরূপে এবং এরা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক। কিন্তু দীর্ঘদিন শরণার্থী শিবিরে থাকছে—এই গৃহচ্যুতর দল পূর্বাগত উদ্বাস্তুর দলে পরিণত হবে। এই শরণার্থীর অবিরাম আগমন পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, আর্থিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে ভেঙ্গে ফেলবে এবং পূর্বাঞ্চল ভারতের দেশরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলবে। ভারতের আর্থিক কাঠামাের উপরেই যে এই শরণার্থীরা প্রচণ্ড আঘাত হানবে তাই নয়, ভবিষ্যতে শরণার্থীর সমস্যা মুখ্য সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের স্বদেশপ্রেমিক মানুষ আজ ভারতের উপবে গভীরভাবে নির্ভরশীল। দীর্ঘায়িত সংগ্রামের পরিস্থিতি এবং পিন্ডিশাহীর বর্বর অভিযান বাংলাদেশের মানুষ ভারতের উপরে বিশ্বাস হারিয়ে হয়তাে চীনমুখী হয়ে যাবে ভাতের প্রত্যাঘাতেই যে পিকিংপন্থী করে তুলেছে—সেই ঘটনাও অজানা নয়। এরূপ পরিবর্তন ঘটলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে চীনা-নীতির আমুল পরিবর্তনেও বিলম্ব ঘটবে না—তাও বলা যায় না। বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে? গেরিলা যুদ্ধের সাফল্যের প্রধান উৎস রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই নেতৃতুদানের মানসিক প্রস্তুত আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগে গঠন ও সংগ্রামের প্রস্তুতি ছিল প্রাক স্বাধীনতা যুগের কংগ্রেসের ন্যায়। তাই আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করেছিল গান্ধীপন্থী অসহযােগ আইন অমান্যের। এই সংগঠাত্মক বৈপ্লবিক মানসিকতার রূপান্তরিত করার জন্য নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ন্যায় নেতৃত্ব এদের মধ্যে নেই। উপরন্তু, বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতাদের গেরিলা সংগ্রাম পরিচালনার সম্ভাবনা পিন্ডিশাহী চরমভাবে দূরুহ করে তুলেছে। তাই, অধিকাংক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী আজ দেশত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে গেরিলা সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব বদল এবং ভারত বিরােধী নেতৃত্বের আবির্ভাবের বিশেষ আশঙ্কা রয়েছে। এরূপ নেতৃত্বের নির্ভরতা অনিবার্যভাবে হবে ভারত-বৈরী চীনের উপরে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশেল দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রাম গােটা পূর্বাঞ্চল ভারতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গৃহযুদ্ধের সংকট যে সৃষ্টি করতে পারে, তা নিছক অতি-দূরদর্শী কল্পনা নয়। বাংলাদেশকে এককভাবে স্বীকৃতি দিলে ভারতকে অনিবার্য ভাবে পাকিস্তান বা পাক-চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হবে, এরূপ আশংকাও সকল মুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়।
রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামরিক, কোন দিক থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের সঙ্গে বর্তমানে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চলে একটি গােটা জাতি বিদ্রোহ করেছে পাক-ফৌজের বিরুদ্ধে। পাকফৌজ রণনৈতিক স্ট্রটেজির দিক থেকে শুধু যে একটি সামগ্রিক বের জনতার ঘেরাওয়ে আবদ্ধ রয়েছে তাই নয়। এই ফৌজ গণ-সংগ্রাম দমনের উদ্দেশ্যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বাঞ্চলে সরবরাহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থাও পাক-ফৌজের অনুকূলে নয়। পশ্চিমাদের থেকে দুই ভিভিসম সৈন্য পূর্ববাংলায় পাঠাবার সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তেও এই ফৌজের আক্রমণ ক্ষমতা ব্যাহত হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও পাক-ফৌজ কোন আক্রমণাত্মক দুঃসাহস দেখায় তাহলে দুই সীমান্তের এই ফৌজের আশু বিপদ ব্যয় সুনিশ্চিত। পূর্বাঞ্চলে পাক-ফৌজের পক্ষে এক সপ্তাহ টিকে থাকাও সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চল পতনের পরে ভারতীয় ফৌজকে পশ্চিমাঞ্চলে পাঠিয়ে পশ্চিম প্রান্তকে শক্তিশালী করা ভারতের পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে না। পাকফৌজের পক্ষে এরূপ সম্ভাব্য পরিণতির কথা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় বলেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার অ্যাডভেঞ্চার করতে উদ্যত না হলে, পাকিস্তানের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়।
রাশিয়ার সম্মতি ও সাহচর্যে চীনা ফৌজ কুরিয়ায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভিয়েনাম, লাওস, বা ক্যাম্বােডিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনের জাতীয় স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে চীন এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে নি। অস্ত্র সরবরাহ চীন এদেশগুলিকেও করেছে, পাকিস্তান কেও করছে। চীন বহুবার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের কোন অঞ্চলের সামরিক সংঘাতে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশীদার হয়নি। পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার জন্য চীন প্রত্যক্ষ রণে অবতীর্ণ হবে, এরূপ চিন্তা আশংকার সামিল। তা ছাড়া চীন জানে যে, আসন্ন বর্ষার সময়ে পূর্ব বাংলায় বা পূর্বাঞ্চল ভারতের কোন প্রান্তে বড় রকমের সৈন্য চলাচল করা এক দুঃসাধ্য প্রচেষ্টায় পরিণত হতে বাধ্য। চীনা একথাও জানে যে ভারত বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে রুশ-মার্কিন সমর্থন ও সহযােগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও, চীন যদি পাকিস্তানের খাতিরে ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয় তা হলে রুশ বা মার্কিন রাষ্ট্র নীরব থাকতে পারবে না। চীন-মার্কিন সমঝােতার সম্ভাবনাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চীন পাকিস্তান রক্ষায় নিজের জাতীয় স্বার্থকে করবে বিপন্ন করবে, এরূপ আন্তর্জাতীয় ঔদার্য চীন কখনও দেখায় নি। বাংলাদেশের স্বীকৃতির পশ্নে চীন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে চীনের আদর্শবাদী প্রতিচ্ছবি যে আন্তর্জাতীয় ক্ষেত্রে কি ভাবে কলঙ্কিত হবে, সে কথাও চীনকে বিবেচনা করতে হবে।
তাই, সমগ্রভাবে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে অযৌক্তিক নয় যে, পাকিস্তান বা পাকচীনের পক্ষে ভারত-বিরােধী আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্র বর্তমানে অনুকূল নয়।
বিরােধী পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে একজন মন্ত্রী বলেন যে, স্বীকৃতি না দিয়েও বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়া যায়। হ্যা, সাহায্য দেওয়া যায়, অপ্রকাশ্যে, গােপনে। কিন্তু ভারতের ন্যায় একটি গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ সাহায্য গােপন রাখা সম্ভব নয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায় বিরাট কাজে এরূপ প্রচেষ্টা সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা কারও পক্ষেই যথার্থ কার্যকর করা যায় না। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই এই দেশের পক্ষে সরকার আন্তর্জাতীয় মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হবে না। একথা সত্য হলে, সেই সঙ্গে অন্য কথাও সত্য হবে যে, একটি সরকার যে মর্যাদা লাভ করবে তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতীয় প্রচার চালিয়ে ভারতে দূতাবাস স্থাপন করে অন্যান্য রাষ্ট্রর স্বীকৃতি অর্জনের পথও সুগম করতে সক্ষম হবে। ভারত সরকারের স্বীকৃতি লাভ করলে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে এই দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণ গ্রহণ করে ভারতের সামরিক সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামকে দ্রুত সম্পূর্ণ করা সহজতর হবে।
বাংলাদেশেল মানুষের হৃদয় জয় করার এবং ভাবী বন্ধুত্ব ও সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্যও ভারতেরই বাংলাদেশকে সর্ব প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া কর্তব্য। ভারত যদি, এককভাবে হলেও, এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নির্ভীকতা দেখাতে পারে তা হলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব হবে অদ্বিতীয় এই অদূর ভবিষ্যতেই ভারত বিশ্ব সমাজে প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানে ভারত অন্য যে কোন রাষ্ট্রের অনুবর্তী হওয়ার অপেক্ষায় থাকলে ভারত আন্তর্জাতীয় ক্ষেত্রে পরনির্ভরতা ও পরমুখাপেক্ষিতার বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যতেও উত্তীর্ণ হতে পারবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!