You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ ও ভারত সরকার
প্রদীপেন্দু মৈত্র

আজ যখন সারা ভারতবর্ষ মুজিবর রহমানের স্বাধীন পূর্ববাংলা সরকারকে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে সােচ্চার, তখন ভারতীয় সংসদে সব দলের সম্মতিতে পূর্ববাংলার মুক্তিকামী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে সংহতি জানিয়ে প্রস্তাব পাস করানাে হলাে। এই প্রস্তাব আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কেননা, এই প্রস্তাবে আসলে একটি ধূর্ত কূটনৈতিক ধোকা অতি সুকৌশলে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বাংলার মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী ঔপনিবেশিক কায়দায় বিবেকহীন শােষণ চালিয়েছে পূর্ববাংলার মানুষের ওপর। ন্যায়কণ্ঠ মুজিবর এই নির্বিচার শােষণের বিরুদ্ধে সংহত করেছেন ওপার বাংলার ভাইদের। তার দৃপ্ত প্রতিবাদে সংকল্পের অনমনীয়তায় আপােসহীন সংগ্রাম এবং তাঁর নীতির প্রতি অভূতপূর্ব জনসমর্থনে আতঙ্কিত পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী তাঁদের শােষণক্ষেত্র নিরঙ্কুশ করবার উৎকট আশায় পূর্ববাংলার সাত কোটি স্বাধীনতাকামী প্রায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর যে পৈশাচিক বর্বরতার তাণ্ডব শুরু করেছে তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাপাচারের কলুষতম সংযােজন। তাই মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের এই মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
সংসদে প্রস্তাব পাস করে ভারত সরকার সে কর্তব্য পালন করে বিশ্বের ন্যায়বাদী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাহবা লাভ সুনিশ্চিত করেছেন ঠিকই; কিন্তু রাজনীতিতে ন্যায়বাদের স্থান কতটুকু?
পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলনের রাজনীতিক গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তান সৃষ্টিকাল থেকে বর্তমান মুক্তি আন্দোলন পর্যন্ত পাক-ভারত সম্পর্কের পর্যালােচনা করলেই এই গুরুত্বের সঠিক আন্দাজ করা যাবে। জিন্না সাহেবের হিংস্র ধর্মান্ধ জিগির নেহেরু প্রভৃতি ভারতীয় নেতাদের অপরিণামদর্শী ক্ষমতালিপ্সা, পলায়মান পাপবুদ্ধি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিভেদ সৃষ্টিকারী হীন চক্রান্ত- এই সবের পটভূমিতে ভারতীয় উপমহাদেশকে খণ্ডিত করে সৃষ্টি করা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের। পাকিস্তানের জন্মলগ্নের এই হিংসা আর পাপ আর বিভেদ পরবর্তীকালে দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে ভারতের শান্তি আর নিরাপত্তার পথে দূরতিক্রম্য বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে গূঢ় অভিসন্ধি নিয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ ভারত বিভাগের পরিকল্পনা করেছিল তা পূর্ণ হতে দেরি হয়নি। পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ব্রিটেন কমিউনিস্ট চীন এমনকি সমাজতন্ত্রী রাশিয়াও ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশ থেকেই রাজনৈতিক মুনাফা শিকার করেছে। পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে ভারতের অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে উন্নতি হয়েছে ব্যাহত।
আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে যে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার ফলে ভ্রান্ত ভারতীয় নেতৃত্ব পাকিস্তান সৃষ্টি মেনে নিয়েছিলেন, সেই ভুল সংশােধনের সুবর্ণ সুযোেগ আজ এসেছে। এই মুহূর্তে মুজিব সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে ভারত সরকারের উচিত স্বাধীন পূর্ববাংলার হাত শক্ত করা। তাহলে পূর্ব সীমান্ত রক্ষা করার বিপুল ব্যয়ভার থেকে রেহাই ভাবে ভারতীয় অর্থনীতি, পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার কাজ হবে সহজ এবং সুদৃঢ়।
অথচ সংসদে ভারতসরকার একটি নিতান্ত জলে নৈতিক প্রস্তাব পাস করালেন কেন? কালহরণের জন্যে? বিশেষ বৃহৎ শক্তিগুলাের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য অবকাশের জন্যে? ধরে নেয়া গেল তাই। ভারত সরকার হয়তাে ভাবছেন, কিছুদিন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে রাশিয়া কিংবা আমেরিকাকে পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনে রাজি করানাে যেতে পারে। কিন্তু এই সমর্থনের আশা করাও এক ভ্রান্ত রাজনীতির পরিচায়ক। যদিও আমেরিকা অথবা রাশিয়া কেউই পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকগােষ্ঠীর চীনা মিতালী সুনজরে দেখে না, তবুও তারা নিজেদের স্বার্থেই পূর্ববাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে ভারতের হাত শক্ত করতে চাইবে না। পাক ভারতের মধ্যে যতিদন ঠাণ্ডা অথবা গরম লড়াই জিইয়ে রাখা চলে ততদিনই তাদের লাভ। স্বাধীন পূর্ববাংলা থেকে তাদের লাভের আশা কম, অথচ ভারতের লাভ সাড়ে যােল আনা। সুতরাং আমেরিকা অথবা তথাকথিত ভারতমিত্র রাশিয়া কোনাে দিনই স্বাধীন বাংলা সরকারকে স্বীকৃতির সবুজ সংকেত দেবে না। যা করার ভারতকে তা নিজের দায়িত্বেই করতে হবে এবং অবিলম্বে।
এই প্রসঙ্গে আর একটি প্রশ্নের বিবেচনা করতে হবে। সেটি হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের। ভারত সরকার পূর্ববাংলার স্বাধীন সত্তা মেনে নিয়ে মুজিব সরকারকে সব রকমে সাহায্য করলে পাকিস্তানের সমরনায়করা পশ্চিম সীমান্তে ভারত আক্রমণ করবে কিনা। করলে, তাদের সম্ভাব্য সহায়ক কোন কোন রাষ্ট্র হতে পারে। আমেরিকা? না। আরেকটি ভিয়েতনাম সৃষ্টি নিক্সন সরকারের বদহজমের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। চীন? সেও না। লড়াই শুধুমাত্র পশ্চিম সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকলে ভারতকে কাবু করা অত্যন্ত সুসাধ্য ব্যাপার। চীনা কমিউনিস্টদের সে কথা বােঝাবার মতাে মগজ আছে। তাছাড়া চীনের সহায়তায় পাকিস্তান দীর্ঘস্থায়ী ভারত বিরােধী যুদ্ধ শুরু করলে আমেরিকার ভারত শিবিরে যােগদানের সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল। সুতরাং ভারতের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে চীনের অস্ত্র ধারণ করা এবং উত্তর সীমান্তে হামলা করার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। বাকি থাকল, রাশিয়া। রাশিয়া তার সমাজতান্ত্রিক মৈত্রীর ভণ্ডামি বজায় রাখতে বাধ্য হবে এবং পূর্ব বাংলাহীন পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের সৌহার্দ্যই বেশি কামনা করবে। অতএব দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের জঙ্গিশাহী যদি আক্রোশবশত ভারতকে আক্রমণ করেই বসে, তবে ভারত তাদের যুদ্ধ বাসনার সমুচিত জবাব দিতে পারবে।
তাহলে এই দ্বিধা কেন? কেন এই নৈতিক সমর্থনের আড়ালে গা বাঁচিয়ে চলবার চেষ্টা। পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধের ঢেউয়ের দোলা পশ্চিমবাংলাতেও আসতে পারে এই আশঙ্কায়? স্বাধীনতায় পরে পশ্চিমবাংলাতেও পূর্ববাংলার ধাঁচে কেন্দ্রীয় সরকারের শােষণ নীতি চলছে অবাধে। সি পি এম রাজ্যের বৃহত্তম দল হিসেবে সম্প্রতি এই অবাধ শােষণের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনের কাজে লেগেছেন। পূর্ববাংলার স্বাধীনতা লাভে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি পশ্চিমের বাঙালিরাও কেন্দ্রের শােষণ নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌম অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম শুরু করেন তাহলে?
সুতরাং ভারতীয় সংসদে এমন একটি সুবিধাবাদী প্রস্তাব পাস করানাে হলাে যা মােচড়ালে নানান ধরনের অর্থ করা যেতে পারে, যেমন, বৃহৎ শক্তিগুলাে চাপ দিলে বলা যেতে পারে ওতাে নির্যাতিত মানবাত্মার সংগ্রামে নৈতিক সমর্থন মাত্র, মুজিবকে বােঝানাে যেতে পারে তার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের পাশে আমরা বরাবরই আছি, আবার স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বীকৃতিকামী ভারতীয় জনসাধারণকে বােঝানাে যেতে পারে, প্রস্তাবটি তাে একরকম স্বীকৃতিরই নামান্তর।

সূত্র: দর্পণ
১৬.০৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!