You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২৮শে আগস্ট ১৯৫৬
শাসকচক্রের অনিয়মতান্ত্রিক ও গণতন্ত্র-বিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জনতার হুঁশিয়ারি
‘প্রতিবাদ দিবসে’ মিছিলের পদধ্বনি ও হরতালের স্তব্ধতায়
ঢাকার বুকে গণ-ঐক্যের অপূর্ব অভিব্যক্তি
ক্ষমতাসীন চক্রের কুশাসনের বিরুদ্ধে পল্টন ময়দানের বক্তাবৃন্দের তীব্র সমালােচনা দলীয় রাজনীতি-দুষ্ট বর্তমান গভর্ণরের অপসারণ ও রাজবন্দীদের আশু মুক্তি দাবী

স্টাফ রিপাের্টার
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের আহ্বানক্রমে গতকল্য (সােমবার) প্রতিবাদ দিবসে রাজধানী ঢাকার বুকে নিয়মতন্ত্র ও গণতন্ত্রবিরােধী তৎপরতায় আসক্ত শাসকচক্রের বিরুদ্ধে গণ-ঐক্যের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি ফুটিয়া ওঠে। হরতালের স্তব্ধতা ও মিছিলের পদধ্বনির মধ্য দিয়া এই দিন ক্ষমতাসীন চক্রের গণবিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জনতার অবিরাম সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার দৃপ্তশপথ মূর্ত হইয়া ওঠে। ক্ষয়িষ্ণু সরকার মন্ত্রিসভার উস্কানিপুষ্ট কোন কোন পুলিশ-কর্মচারী ও সরকারের ‘পারমিট-পুষ্ট এক শ্রেণীর মুখ চেনা লােকের নির্যাতনমূলক হীন তৎপরতা অগ্রাহ্য করিয়া শহরবাসী জনসাধারণ এই দিন হরতাল পালন করে। অপরাহ্নে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসমাবেশে বিভিন্ন বক্তা ক্ষমতাসীন চক্রের গণবিরােধী কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা করিয়া বক্তৃতা করেন। দলীয় রাজনীতি-দুষ্ট গভর্ণর জনাব এ, কে, ফজলুল হকের আশু অপসারণ ও অবিলম্বে সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবীতে সভাপতির আসন হইতে মওলানা ভাসানী প্রস্তাব উত্থাপন করিলে তুমূল হর্ষধ্বনির মধ্যে পল্টন ময়দানের এই ঐতিহাসিক জনতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে হস্ত উত্তোলন করিয়া উহাতে সম্মতি জানায়। নিরপেক্ষ শ্রোতাদের মতে পল্টন ময়দানে এতবড় জনসমাবেশ ইতিপূর্বে আর কখনও পরিলক্ষিত হয় নাই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, প্রতিবাদ দিবসের ডাকে সাড়া দিয়া এই দিন শহরবাসী জনসাধারণ সকাল হইতেই বাস, ট্যাক্সি, রিকশা-চলাচল এবং দোকানপাট বন্ধ করিয়া হরতাল পালন করে। দুই একখানি প্রাইভেট কার রাস্তায় বাহির হইলে পিকেটিংরত কর্মীদের অনুরােধে গাড়ীর আরােহী গাড়ী ছাড়িয়া পব্রজে গন্তব্য স্থলাভিমুখে রওয়ানা হন। বেলা ৯টায় পর্যন্ত কর্মরত পুলিশ বাহিনীকে কর্মীদের এই শান্তিপূর্ণ পিকেটিং-এ কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায় নাই। বেলা ৯টার পর কোন কোন পুলিশ কর্মচারীদের অকস্মাৎ অতি উৎসাহী হইয়া কর্মীদের শান্তিপূর্ণ পিকেটিং-এ বাধা দিতে দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়। অতঃপর রাস্তায় কিছু কিছু রিকশা চলাচল করিতে দেখা যায়, কিন্তু বাস ও ট্যাক্সি চলাচল সারাদিন বন্ধ থাকে। অপরাহ্নে বিভিন্ন মহল্লা হইতে দলে দলে লােক পল্টন ময়দান অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। অপরাহ্ন ৪টা নাগাদ পল্টন ময়দানটি বিরাট জনসমুদ্রে পরিণত হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, ঢাকার স্বার্থান্বেষী মহলের একটি বাংলা পত্রিকায় রিকসা চালকদের ধর্মঘট হইবে না বলিয়া একটি বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় বেলা ৯টার পর শহরে কিছু সংখ্যক রিকশা চলিতে দেখা যায়।
মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা
পরিশেষে সভার সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বক্তৃতা দিতে উঠিয়া বলেন, গত ৯ বৎসরে শাসক-চক্র পূর্ব পাকিস্তানকে শ্মশানে পরিণত করিয়াছে আর আজ দেশ হইতে গণতন্ত্রকে সরাইয়া আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হইয়াছে। তিনি জানান যে, গত রবিবার তিনি উত্তরবঙ্গ সফরের পর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। তথায় জনসাধারণ আজ মরণের মুখে দাঁড়াইয়াছে। চারিদিকে কেবল খাদ্যের অভাবে হাহাকারের সৃষ্টি হইয়াছে। তিনি বলেন, মানুষ আজ দুটো কাঁঠালের পরিবর্তে প্রাণপ্রিয় সন্তানকে পর্যন্ত বিক্রি করিতেছে এবং বাধ্য হইয়া বাঞ্ছত্যাগ করিতেছে। মওলানা সাহেব বলেন, প্রায় ৯ মাস পূর্বে এই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সরকারকে জানানাে হইয়াছে কিন্তু আজ পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করিতেছে। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র কায়েম থাকিলে এইরূপ অবস্থার সৃষ্টি হইত না। তাই আজ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য সকলের নিকট এক মহান দায়িত্ব আসিয়া পড়িয়াছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশের এই সংকটজনক মুহূর্তে গণতন্ত্রকে কায়েম রাখার জন্য সকলের নিকট এক কাতারে সমবেত হওয়ার আবেদন করেন। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি বলেন, আমরা কন্ট্রোল ডেমােক্রেসী চাই না, পিওর ডেমােক্রেসী চাই।’ প্রাদেশিক গভর্ণরের কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা করিয়া তিনি বলেন, জনাব ফজলুল হক পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখিয়া যে অগণতান্ত্রিক কাজ করিয়াছেন, সমগ্র বিশ্বের ২৬০ কোটি লােক তাহার নিন্দা করিতেছে, এমনকি ফেরেশতারাও ইহাতে শরীক হইয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহুত এবং প্রদেশের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সমর্থিত এই প্রতিবাদ দিবসে ঢাকা শহরে ব্যাপক হরতাল পালনের প্রস্তুতি চলে এবং সেই প্রস্তুতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, শহরের জীবন প্রদেশের। খাদ্যাবস্থার জন্য মওলানা ভাসানী ‘যুক্তফ্রন্ট সরকারকে তীব্র সমালােচনা করিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্ভিক্ষ এলাকা বলিয়া ঘােষণা করার দাবী করেন। তিনি বলেন, আজ সকল প্রকার প্রসাধনী দ্রব্য আমদানি বন্ধ করিয়া বৈদেশিক মুদ্রা দিয়া দুনিয়ার যে কোন দেশ হইতে খাদ্য আমদানি করা প্রয়ােজন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে অনাহারে মৃত্যুর ধকল হইতে বাচাইবার জন্য সরকারি-বেসরকারি সকলকে আগাইয়া আসার আবেদন জানান। তিনি বলেন, পুর্ব পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে বাঁচাইতে হইলে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রয়ােজন। আজ পূর্ব পাকিস্তানী মাত্রেই এই প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই সময় মওলানা ভাসানী পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, রাজবন্দীদের মুক্তি ও প্রাদেশিক গভর্ণর জনাব ফজলুল হকের পদত্যাগ দাবী করিয়া উপস্থিত শ্ৰোতামণ্ডলীর মতামত জানিতে চাহিলে উপস্থিত শহস্র শহস্র লােক গগনভেদী আওয়াজ করিয়া দাবীর প্রতি সমর্থন জানায়। অতঃপর মওলানা ভাসানী পঞ্চবার্ষিকী। পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদদের জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।
তিনি বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রভৃতি পূর্ব পাকিস্তানীদের জীবন-মরণ প্রশ্নে কে মােনাফেকি করিয়াছে, তাহা পরম শক্তিমান আল্লাহ জানেন আবেগময় কণ্ঠে মওলানা সাহেব বলেনঃ ‘আল্লাহর দোস্ত আমার দোস্ত আল্লাহর দুশমন আমার দুশমন। তিনি পুনরায় বলেন,পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম করার জন্য বাংলার ৪ কোটি লােক মৃত্যুবরণ করিবে, তবুও এই দাবী পরিত্যাগ করিবে না। মওলানা ভাসানী পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, যুক্ত নির্বাচন, খাদ্য সমস্যা সমাধানের দাবী ও গণতন্ত্রকে কায়েম করার জন্য জনসাধারণের নিকট আকুল কণ্ঠে আবেদন করেন। তিনি মেডিক্যাল ছাত্রদের দাবী সমর্থন করিয়া বলেন, এই দাবী আদায় না হইলে তিনি অনশন ধর্মঘট করিতে বাধ্য হইবেন। পরিশেষে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানীরা যে কোন রকমে ২১-দফার দাবীকে আদায় করিবেই। মন্ত্রীসভা গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, যে দলই মন্ত্রীসভা গঠন করুন না কেন, জনসাধারণের দাবী মানিতে তাহারা বাধ্য থাকিবেন এবং কেন্দ্র হইতে কোনরূপ অগণতান্ত্রিক নির্দেশ হইলেই সেই মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করিতে হইবে। এই সময় তিনি আল্লাহ পাকের দরগায় মােনাজাত আরম্ভ করেন এবং গণতান্ত্রিক দাবীসমূহ কার্যকর করার জন্য শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের দোয়া কামনা করেন। অতঃপর প্রথমে মওলানা সাহেব স্বয়ং এবং পরে শেখ মজিবর রহমান প্রস্তাব পেশ করিলে উপস্থিত শ্ৰোতৃমণ্ডলী হস্ত উত্তোলন করিয়া প্রস্তাবসমূহের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। সভার শেষে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে সভাস্থল হইতে এক বিরাট শােভাযাত্রা সদরঘাট পর্যন্ত গমন করে। এই সময় গুলিস্থান সিনেমা হইতে সদরঘাট পর্যন্ত লােকে লােকারণ্য হয়ে যায় এবং প্রায় পৌণে এক ঘণ্টা পর্যন্ত সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যায়। শােভাযাত্রা শেষে সদরঘাটে জনাব আতাউর রহমান প্রমুখ নেতা বক্তৃতা প্রদান করেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা
তুমূল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলীয় নেতা এবং সভার প্রধান বক্তা জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বক্তৃতা দিতে উঠিয়া বলেন, আজকের এই স্মরণীয় দিনে আমি এই কথা পুনরায় ঘােষণা করিতে চাই যে, সরকার মন্ত্রিসভার যদি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তবে পরিষদে অবিলম্বে ভােট গ্রহণ করা হউক। আর এই পদ্ধতি গ্রহণে সাহসী না হইলে সরকার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা উচিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সরকার পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন নাই বা পদত্যাগও করেন নাই। ফলে এখন প্রাদেশিক গভর্ণর জনাব ফজলুল হককেই সরকার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করিতে হইবে। আর যদি জনাব হক ইহা না করেন তবে তিনি নিজেই বরখাস্ত হইয়া যাইবেন। এইসময় সভার মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। জনাব সােহরাওয়ার্দী অতঃপর বিপুল করতালির … তাই যাহারা গণতন্ত্রের পূজারী তাহারাই টিকিয়া থাকিবেন এবং যাঁহারা গণতন্ত্রের বিরােধিতা করিবেন তাহাদের পতন অনিবার্য। এই প্রসঙ্গে আওয়ামী প্রধান জনতার দাবী প্রতিধ্বনি করিয়া তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বলেন,পূর্বপাকিস্তান কোনদিন একনায়কত্ব সহ্য করিবে না। কারণ অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ দ্বারা জনাব নূরুল আমীন যে শ্বাসরােধকারী পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, সেইসময় টাঙ্গাইলে একটিমাত্র উপনির্বাচন হইয়াছিল এবং সেই উপনির্বাচনে এদেশের জনসাধারণ মুসলিম লীগকে পরাজিত করিয়া তাহাদের রায় প্রদান করে। ইহার পরই নুরুল আমীন ৩২টি উপনির্বাচন বন্ধ রাখেন পৃথিবীর পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে ইহার নজীর নাই। তাই গত নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাহার ফল ভােগ করিয়াছে। কারণ এদেশের জনগণ সকল সময়ই গণতন্ত্রের পূজারী।
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, ইহার পর বগুড়ার জনাব মােহাম্মদ আলী জনাব আবু হােসেন সরকারকে ১৯৫৫ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপাইয়া দেন। আর তারই ফলস্বরূপ জনাব সরকার আজ পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের একটিও পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন আহবান করিতে সাহসী হন নাই। তিনি আরাে বলেন ,জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ শেষবারের মত ১৯৫৩ সালের বাজেট পাশ করেন। কিন্তু তাহার পর হইতেই প্রদেশের বাজেট কেবল সার্টিফিকেট আর অর্ডিনেন্স দিয়াই পাশ করানাে হইতেছে। আজ যদি সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে এইসব অপূর্ব নজীর তুলিয়া ধরা হয় ,তবে বিশ্ববাসী কেবল বিদ্রুপই করিবে। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, পাকিস্তানে এই কি গণতন্ত্র? গত সাড়ে তিন বত্সরের মধ্যে এই প্রদেশের বাজেট পরিষদে পেশ করা হয় নাই – ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কি থাকিতে পারে? জনাব সােহরাওয়ার্দী অতঃপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা করিয়া বলেন, ওয়াদা মত এই মন্ত্রীসভা একটিও উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের সাহসী হন নাই। জনাব ফজলুল হকের নিজস্ব দুইটি নির্বাচনী এলাকার আসন শূন্য রহিয়াছে। অথচ বর্তমান সরকার এই দুইটি আসনে উপনির্বাচন ঘােষণা করেন নাই। সুতরাং সহজেই বুঝা যায়, এই সরকারের প্রতি কিরূপ জনসমর্থন রহিয়াছে। প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশনের মাত্র চার ঘণ্টা পূর্বে অধিবেশন স্থগিত করার কার্যক্রমকে জনাব সােহরাওয়ার্দী দুনিয়ার পার্লামেন্টারী ইতিহাসে নজীরবিহীন বলিয়া উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে জনাব ফজলুল হকের এই কীর্তিকে সমগ্র বিশ্ব ক্রিপ করিতেছে। জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী আরও বলেন, যখন জনাব হক নিশ্চিতভাবে বুঝিতে সক্ষম হইলেন যে, পরিষদে সরকার-মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হইয়া যাইবে, তখন জনাব হক মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ প্রদানের কৈফিয়ৎ প্রদান করিতেছেন এবং শাসনতন্ত্রে বিধানের উল্লেখ করিতেছেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, শাসনতন্ত্রে এইরূপ বিধান রহিয়াছে যে, যখন গভর্ণর উপলব্ধি করেন যে, সরকারের… বলেন, জনাব ফজলুল হক সাহেব এখন পর্যন্ত কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা রহিয়াছেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি গভর্ণর তাহার নিরপেক্ষ থাকা প্রয়ােজন। জাতীয় পরিষদের নেতা এই সময় ঘােষণা করেন যে , কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ যদি গণতন্ত্রকে কায়েম রাখিতে চাহেন তবে অবিলম্বে মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত এবং প্রাদেশিক সরকারেকে গভর্ণরকে করা উচিত। কারণ ইহারা শাসনতন্ত্র বিরােধী। কাজ করিয়াছেন। তিনি বলেন, মাত্র সেইদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হইয়াছে এবং শাসন তন্ত্রের বিধান লংঘন করা হইবে না বলিয়া কেন্দ্রীয় সরকার শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। অথচ এখন ইহারা সরকার মন্ত্রী সভাকে বরখাস্ত করিতেছেন না। কারণ জনাব মােহাম্মদ আলীর নিজের গদি রক্ষার জন্য ইহাদের সমর্থনের প্রয়ােজন রহিয়াছে। এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, নিজেদের দল ভারী করার জন্য করাচী হইতে কোন কোন নেতাকে ডাকিয়া পাঠানাে হয়। কিন্তু তাহারা এই কার্যে সাফল্য লাভ করেন নাই। তিনি আরাে বলেন, বর্তমানে শুনিতে পাইতেছি যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা রাজবন্দীদের মুক্তি প্রদানের কথা চিন্তা করিতেছেন। ইহা অত্যন্ত ভাল কথা। কারণ, যুক্তফ্রন্ট এ পর্যন্ত গণতন্ত্র বিরােধী কার্যকলাপের দ্বারা যে পাপ করিয়াছেন, রাজবন্দী মুক্তির মধ্য দিয়া ইহার প্রাশ্চিত্ত হওয়া প্রয়ােজন। জনাব সােহরাওয়ার্দী রাজবন্দীদের মুক্তি দাবী করিয়া বলেন, আজ ৪ জন পরিষদ সদস্যসহ কিছু লােককে বিনা বিচারে আটক রাখা হইয়াছে ,ইহা চরম অন্যায়। গত ৭-৮ বৎসর যাবৎ ইহাদের কারাগারে আটক রাখা হইয়াছে। ইহাদেরও স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কি কিছুই নাই? তিনি আরাে বলেন, আল্লা কোনদিনই গদিনশীন সরকারের অবিচার করার অধিকার দেন নাই। আপনারাই চিন্তা করুন আপনাদের কাহাকেও বিনা বিচারে কারাগারে আটক করিলে তাহাদের পরিবারের কি অবস্থা হইবে ? পরিশেষে জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক না আসুক তাতে কিছু যায় আসে না; কিন্তু আওয়ামী লীগ সবসময়ে গণতন্ত্রকে কায়েম রাখার জন্য সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে। জনাব সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা হইতে জনাব চুন্দ্রীগড় ও জনাব পীর আলী মােহম্মদ রাশদীর পদত্যাগ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, তিনি জাতীয় পরিষদে বিরােধীদলে রহিয়াছেন এবং গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালাইতেছেন। তিনি বলেন, আজ নীতির প্রশ্নই সকলের ঊর্ধ্বে রহিয়াছে এবং নীতিকে আমরা সর্ব সময়েই কায়েম রাখিব।
জনাব সােহরাওয়ার্দী জনসাধারণকে নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে হুঁশিয়ারি হওয়ার আবেদন করেন। তিনি বলেন, সত্যের পথ আমাদের পথ। আমাদের কোনরূপ। বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে আপনারা আমাদের সঠিক নির্দেশ দিবেন। জনাব সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সভা শহীদ-ভাসানী জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠে।
জনাব আতাউর রহমান খান
প্রাদেশিক পরিষদের বিরােধীদলের নেতা ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, প্রাদেশিক গভর্ণর জনাব ফজলুল হক গত ১৩ আগষ্ট এক নির্দেশ বলে পরিষদেও অধিবেশন স্থগিত করিয়া দেন। তাহার এই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানই নয় পশ্চিম পাকিস্তানও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার গণতান্ত্রিক বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে বাধ্য হইয়াছেন। অতপরঃ জনাব আতাউর রহমান যুক্তফ্রন্টের কীর্তিকলাপ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন জনাব ফজলুল হক ও জনাব আবু হােসেন সরকার ২১ দফা দাবীকে নস্যাৎ করিয়াছেন এবং ইহারা গণতান্ত্রিক দাবীসমূহ বিনষ্ট করার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। গদি রক্ষাই ইহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি আরাে বলেন, গত এক বৎসরেরও উপর জনাব আবু হােসেন একটির পর একটি অগণতান্ত্রিক কাজ করিয়াছেন। এমনকি এই মন্ত্রীসভা সরকারী পর্যায়ে যতগুলি কমিটি গঠন করিয়াছেন, প্রত্যেকটি কমিটিতে আওয়ামী লীগারদের সযত্নে বাদ দেওয়া হইয়াছে। অথচ আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা পরিষদের এক …। গণতান্ত্রিক দাবী যেখানে অবহেলিত সেখানে বিপ্লব হওয়া অবশ্যম্ভাবী। আওয়ামী লীগ এই গণতান্ত্রীক দাবীসমূহের জন্য সংগ্রাম চালাইতেছেন। অথচ সরকার এই গণতান্ত্রিক দাবী নস্যাৎ করিয়া বিপ্লবের রাস্তাই পরিষ্কার করিতেছেন। জনাব রহমান বলেন, আজিকার এই হরতালকে বানচাল করার জন্য গভর্ণরের বাসভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হইয়াছে। জনাব ফজলুল হক নিজেই হরতালের জন্য আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। কারণ যে সকল দাবীর ভিত্তিতে এই হরতাল আহবান করা হইয়াছে,তাহার মধ্যে জনাব হকের সাম্প্রতিক কাৰ্যকলাপের প্রতিবাদ জ্ঞাপনও রহিয়াছে। জনাব ফজলুল হকের কাৰ্যকলাপের ফিরিস্তি প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের দাবীসমূহকে পদদলিত করিয়া জনাব হক গভর্ণরের পদ লাভ করিয়াছেন। তিনি চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী গভর্ণরকে রাজনীতির উর্ধ্বে থাকা উচিত এবং এই ব্যাপারে তাহাকে উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল। অথচ জনাব হক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হইয়া পড়িয়াছেন এবং তাহার বাসভবনে ঘন ঘন বৈঠকও হইতেছে। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে অবহিত রহিয়াছেন। প্রাদেশিক পরিষদের। বিরােধীদলের নেতা আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া যে নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন , প্রাদেশিক ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলীয় লােকেরা উহাকে বানচাল করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হইয়াছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মােতাবেক ৩০ আগস্টের বেশি একদিন ‘যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার উপায় নেই জানিয়াও গভর্ণরও বিরােধীদলের কোন নেতাকে জানাইয়াছেন যে ,তিনি ইচ্ছা করিলে আরও কিছুদিন পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় রাখিতে পারেন এবং এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পাইতে বাধ্য। জনাব রহমান আরও বলেন, আজ বাদে কাল জনাব ফজলুল হক কবরে যাইবেন, কিন্তু পূর্ব বাংলাকে কবরে পরিণত করিতেছেন। পরিশেষে তিনি আবেগময়ী কণ্ঠে পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক দাবীসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামের জন্য সকলকে প্রতিজ্ঞা গ্রহণের আবেদন করেন।
জনাব শেখ মজিবরের বক্তৃতা
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মজিবর রহমান বক্তৃতা প্রদান সম্পর্কে এই হরতালকে সাফল্য মণ্ডিত করার জন্য ঢাকার জনগণকে অভিনন্দন। জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, এই হরতালে সরকার পক্ষ হইতে উস্কানী দেওয়া সত্ত্বেও কর্মিগণ যেভাবে শান্তি অক্ষুন্ন রাখেন তাহার জন্য কর্মীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। জনাব রহমান সরকারের বিনাবিচারে আটকের নীতির তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, গত কিছুদিন যাবৎ সরকার-মন্ত্রীসভা ১৪৪ ধারা জারি করিয়া ব্যক্তিস্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করিয়াছে। ফলে সভা করা মুশকিল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের শােষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দুইশত বৎসরে ইংরেজ আমাদের যে ক্ষতি করিয়াছে। জনাব মােহাম্মদ আলী কয়েক বৎসরে তাহাই করিয়াছে। ফলে আজ চারিদিকে শুধু বেকারত্ব আর খাদ্যাভাব লাগিয়াই রহিয়াছে। তিনি বলেন, যুক্তফ্রন্ট নেতৃবৃন্দই পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থকে কেন্দ্রের নিকট বিকাইয়া দিয়াছে। জনাব রহমান প্রাদেশিক গভর্ণরের পদত্যাগ দাবী করেন। পরিশেষে তিনি সকলকে সংঘবদ্ধ হওয়ার আবেদন করিয়া বলেন, আল্লার উপর বিশ্বাস আর ঈমান ঠিক থাকিলে সত্যের জয় অবধারিত।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!