দৈনিক ইত্তেফাক
২০শে মে ১৯৫৬
আওয়ামী লীগ সর্ব অবস্থায় দেশবাসীর খেদমত করিয়া যাইবে
কাউন্সিল অধিবেশনে জনাব সােহরাওয়ার্দীর ভাষণ
খাদ্য সমস্যাকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখিবার আবেদন
মওলানা ভাসানী কর্তৃক খাদ্যের দাবীতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বান
স্টাফ রিপাের্টার
গতকল্য (শনিবার) সকাল দশ ঘটিকায় রূপমহল হলে মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতেই জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন আরম্ভ হয়। এই অধিবেশনে মােট ৬৫০ জন কাউন্সিলারদের মধ্যে চার শতাধিক কাউন্সিলার উপস্থিত ছিলেন। কাউন্সিল অধিবেশনে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকি বা নাই থাকি তাহাতে বিশেষ কিছুই আসিয়া যায় না। আমরা জনসাধারণের খেদমত করিতে চাই।’ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবর রহমান ও বিভিন্ন জেলা সম্পাদকগণ রিপাের্ট পেশ করেন। মওলানা ভাসানী অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল হইতে কাউন্সিলারদের নিকট এক বাণী প্রেরণ করেন।
শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা
তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী বক্তৃতা দিতে উঠিয়া বলেন, আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকি বা নাই থাকি, তাহাতে বিশেষ কিছু আসিয়া যায় না। আমরা জনসাধারণের ও দেশের খেদমত করিতে চাই। তিনি প্রদেশের। মনােনীত সরকার মন্ত্রিসভার চাউল কেলেঙ্কারীর তীব্র সমালােচনা করেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় সরকারের সমালােচনা করেন। তিনি অবিলম্বে মওলানা ভাসানীর দাবি মােতাবেক খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানান। জনাব সােহরাওয়ার্দী মওলানা ভাসানীর প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। তিনি জানান। যে, প্রেসিডেন্ট মীর্জার সহিত তিনি যুক্তভাবে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা সফর করবেন। গতকল্য (শনিবার) সকালে রূপমহল হলে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন আরম্ভ হয়। সর্বপ্রথমে জনাব শেখ মজিবর রহমান তাঁহার রিপাের্ট পেশ করেন। জনাব রহমান তাঁহার রিপাের্টে দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, খাদ্য সংকট এবং বন্যা সম্পর্কে ব্যাপক আলােকপাত করেন। তিনি সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা করেন। বক্তৃতার উপসংহারে তিনি খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য সকল আওয়ামী কর্মীকে গ্রামে গ্রামে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিয়া যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি পুনরায় ক্ষমতাসীন দলের নিকট খাদ্য সমস্যাকে রাজনীতির উর্ধ্বে স্থান দেওয়ার আবেদন জানান। গতকল্য আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন প্রায় চার ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয় এবং অদ্য সকাল আট ঘটিকা পর্যন্ত মুলতবী রাখা হয়। গতকল্যকার অধিবেশনে বিভিন্ন জেলা হইতে আগত আওয়ামী লীগ সম্পাদকগণ স্ব স্ব জেলার খাদ্য পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার পর্যালােচনা করিয়া রিপাের্ট পেশ করেন। অধিবেশনে গত কাউন্সিল সভার কার্যবিবরণী অনুমােদন করা হয়।
প্রস্তাব
আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের সভায় জনাব এস, ওয়াজেদ আলী কর্তৃক প্রস্তাবিত এবং জনাব এম, এ, বারী কর্তৃক সমর্থিত এক প্রস্তাবে জনগণের অসন্তোষের ঝুঁকি না লইয়া যাহাতে আগামী সাধারণ নির্বাচন ১৯৫৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের পর স্থগিত রাখা না হয় তজ্জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বনের জন্য নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে অনুরােধ করা হয়। জনাব এস, ওয়াজেদ আলী কর্তৃক প্রস্তাবিত এবং জনাব এম, এ, বারী কর্তৃক সমর্থিত অপর এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, জনাব মােহাম্মদ আলী ও জনাব এ, কে, ফজলুল হক কর্তৃক অধিকৃত জাতীয় পরিষদের দুইটি আসন শূন্য হইয়াছে। শাসনতন্ত্রের ১৪১ ধারা অনুযায়ী আসন শূন্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া উচিত। পূর্ব পাকিস্তানের উপরােক্ত দুইটি শূন্য আসনের ব্যাপারে আগামী ২২শে জুন তিন মাস মেয়াদ শেষ হইবে। সুতরাং আগামী ২২শে জুনের পূর্বে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সহিত পূর্ব পাকিস্তানের এই শূন্য আসন দুইটি পূরণের প্রশ্ন লইয়া আলােচনার জন্য এই সভা জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে অনুরােধ করিতেছে।
মওলানা ভাসানীর বাণী
মওলানা ভাসানী কাউন্সিলারদের নিকট নিমােক্ত বাণী প্রেরণ করেনঃ- দীর্ঘদিন অনশনজনিত দুর্বলতার জন্য আপনাদের মধ্যে উপস্থিত হইতে না পারিয়া আমি অবর্ণনীয় বেদনা অনুভব করিতেছি এবং আমার এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছি। জাতীয় জীবনে এই দুর্যোগ এবং ভীষণ সঙ্কটময় মুহূর্তে এবং চরম আর্থিক দুর্দিনে কাউন্সিল অধিবেশনে যারা যােগদান করিয়াছেন; আমি তাঁহাদের মােবারকবাদ জানাইতেছি।
সমগ্র দেশ আজ এক অভূতপূর্ব খাদ্যাভাবের সম্মুখীন। এই খাদ্য সঙ্কটের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকারই দায়ী কিনা, উহা দেশবাসী বিচার করিবেন। জনসাধারণের অর্থনৈতিক জীবনের এই চরম দুরবস্থা দেখিয়া আপনাদের বিনা অনুমােদনেই অনশন ধর্মঘট করিয়াছিলাম। আমি আশা করি, আপনারা আমার এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধ ক্ষমা করিবেন। পাকিস্তান সরকারের আশ্বাসে এবং আমাদের নেতা জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আমার দেশবাসী শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরােধে অনশন ভঙ্গ করিয়াছি। দেশের এই খাদ্য সঙ্কটে আপনাদের দায়িত্ব অপরিসীম। খাদ্যের দাবিতে আপনারা আন্দোলন গড়িয়া তুলুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানির জন্য সরকারের নিকট চাপ দিন। দেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার আপনাদের এই সহযােগিতার আহ্বান জানাইলে সাড়া দেওয়ার জন্য অনুরােধ জানাইতেছি। খাদ্য সমস্যা ব্যক্তি বা দলের সমস্যা নয়, এই সমস্যা সমগ্র জাতির। খাদ্য সমস্যাকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখিতে হইবে।