You dont have javascript enabled! Please enable it! 1956.05.06 | দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মওলানা ভাসানীর প্রতি অনশন ভঙ্গের আহ্বান | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
৬ই মে ১৯৫৬
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মওলানা ভাসানীর প্রতি অনশন ভঙ্গের আহ্বান
পরিষদ ও কর্মীদের যুক্ত সভায় প্রস্তাব গ্রহণ
বার্ধক্য জর্জরিত নেতার স্বাস্থ্যাবনতির সংবাদে উদ্বেগ প্রকাশ
শেখ মজিবর ও অপর দুইজন পরিষদ সদস্যের কাগমারী যাত্রা

স্টাফ রিপাের্টার
দেশের বর্তমান খাদ্য সংকটের প্রতিবিধানের দাবীতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনশনজনিত পরিস্থিতি আলােচনার জন্য গতকল্য (শনিবার) সন্ধ্যা সাড়ে সাত ঘটিকায় ৫৬, সিস্পসন রােডে জনাব শেখ মজিবর রহমানের(এম,পি) সভাপতিত্বে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও পরিষদ সদস্যদের এক জরুরি অধিবেশন হয়। সভায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় আগামী ১৯শে এবং ২০শে মে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর অধিবেশনের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে মওলানা ভাসানীকে আগামী ১৯শে মে পর্যন্ত অনশন স্থগিত রাখিবার অনুরােধ জ্ঞাপনের অভিমত প্রকাশ করা হয়। এতদুদ্দেশ্যে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান (এমপি), জনাব ইয়ার মােহাম্মদ খান এম,এল, এ এবং জনাব সিরাজুদ্দীন আহমদ এম, এল, এ, কাগমারী রওয়ানা হইয়া যাইতেছেন। মওলানা ভাসানীর অনশনজনিত পরিস্থিতি আলােচনার জন্য সিটি আওয়ামী লীগের কর্মীবৃন্দও পৃথকভাবে এক বৈঠকে মিলিত হন। অদ্য (রবিবার) বেলা পাঁচ ঘটিকায় তাহারা পুনরায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ অফিসে এক বৈঠকে মিলিত হইবেন।
জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিবৃতি
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব শেখ মজিবর রহমান (এম,পি) সংবাদপত্রে নিমােক্ত বিবৃতি দিয়াছেন: “ইউরােপ সফর হইতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দেশব্যাপী ভয়াবহ খাদ্য সংকট এবং এই নজীরবিহীন দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রতি উদাসীন সরকার মন্ত্রিসভার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনশনের সংবাদ শুনিয়া অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি।
“দুর্গত ও দুঃস্থ জনগণের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আওয়ামী লীগ খাদ্য সমস্যাটির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করিয়াছে এবং প্রতিদিন এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণে তৎপর রহিয়াছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা শুধুই সরকারের মুখের দিকে তাকাইয়া বসিয়া থাকিতে পারি না। সরকার যাহাতে জনগণের দিকে দৃষ্টিপাত করেন তজ্জন্য আমাদিগকে কার্যকরী ব্যবস্থাও অবলম্বন করিতে হইবে। কাজেই, আমি প্রদেশব্যাপী আওয়ামী লীগের সকল ইউনিটকে অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ ঘরােয়া ও প্রকাশ্য জনসভা অনুষ্ঠান এবং বর্তমান অভাবনীয় খাদ্য পরিস্থিতির প্রতি উদাসীন সরকার মন্ত্রিসভায় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ভুখা মিছিলের আয়ােজন করার আহ্বান জানাইতেছি। আগামী ১৯শে মে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের যে অধিবেশন হইবে উহাতে এতদসম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে।”
আওয়ামী লীগ এম,পি ও এম,এল এদের যুক্ত বিবৃতি
মেসার্স জহিরুউদ্দীন এম,পি, আবদুল হামিদ চৌধুরী, এম,এল,এ, মহীউদ্দীন আহমদ এম, এল, এ, ইয়ার মােহাম্মদ খান এম, এল, এ, মােসলেম আলী মােল্লা এম,পি, আমিনা বেগম এম, এল, এ, হাফিজ হাবিবুর রহমান এম, এল, এ, শামসুল হক এম, এল, এ, তাজুদ্দীন আহমদ এম, এল, এ, আবদুল হামিদ মজুমদার এম, এল, এ ও সিরাজুল হক এম, এল, এ, মওলানা ভাসানীকে উদ্দেশ্য করিয়া সংবাদপত্রের নিমােক্ত বিবৃতি দিয়াছেন: দেশের বর্তমান খাদ্য সংকটের প্রতি উদাসীন সরকার রাজনৈতিক চৈতন্যোদয়ের উদ্দেশ্যে আপনার অনশন শুরুর সংবাদে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান সরকার মন্ত্রীসভা টলটলয়ামান ক্ষমতার গদি রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের চরম খাদ্য পরিস্থিতির কথা বিস্মৃত হইয়া ষড়যন্ত্রমূলক দলীয় রাজনীতিতে মত্ত রহিয়াছেন। দেশের দুর্গত জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের ব্যাপারে এই মন্ত্রীসভা সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। হতভাগ্য পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা পীড়িত জনগণের প্রতি আপনার অন্তহীন দরদের কথা আমরা অবহিত আছি। তাই মনে করি যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি যে কর্মপথ বাছিয়া লইয়াছেন তাহা ছাড়া জনগণকে রক্ষা করিবার দ্বিতীয় কোন উপায়। আপনার ছিল না। কিন্তু আমরা মনে করি যে, হতভাগ্য ও দুস্থ মানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে আপনার অর্থাৎ আপনার জীবন রক্ষার প্রয়ােজন অত্যন্ত বেশি। দেশবাসী কোনভাবেই বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনাকে হারাইবার কথা চিন্তাও করিতে পারে না। আমাদের উদ্দেশ্য হাসিলের পথে আপনার নেতৃত্ব ও পরিচালনার এখনও শেষ হয় নাই, আগামী বহু বৎসরব্যাপী আপনার পরিচালনার প্রয়ােজন রহিয়াছে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের পক্ষ হইতেও আমরা আপনাকে এই ওয়াদা দিতেছি যে, দেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি যখন যে নির্দেশ দিবেন, আমরা নির্বিকারচিত্তে তাহাই মানিয়া চলিব। এজন্য প্রয়ােজনবােধে যে কোন ত্যাগ স্বীকারেও আমরা কুণ্ঠিত হইব না। আপনার বর্তমান। স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করিয়া আমরা আপনাকে আগামী ১৯শে মে পর্যন্ত অনশন স্থগিত রাখিবার বিনীত অনুরােধ জানাইতেছি।”
ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের বিবৃতি
বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদের আহ্বায়ক জনাব আবদুল মমিন তালুকদারও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এম, এ, আউয়াল নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়াছেন:
দেশের খাদ্য পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করিয়াছে। মানুষ অনাহার ও অর্ধাহারে জর্জরিত হইয়া দিন দিন মৃত্যুর দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। এমন কি মফস্বল হইতে অনাহারে মৃত্যু সংবাদও পৌছিতেছে। সরকার খাদ্য সমস্যা লইয়া মাথা ঘামাইতেছেন বলিয়া আদৌ মনে হইতেছে না। অত্যন্ত বিলম্বে মুখ্যমন্ত্রী জনাব সরকার খাদ্য সংকটের কথা স্বীকৃতি দিলেও, এ ব্যাপারে কোন সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ। করিতেছেন না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব মােহাম্মদ আলী পূর্বপাকিস্তানকে ঋণদানের কথা ঘােষণা করিয়াই যেন দুর্ভিক্ষপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কর্তব্য শেষ করিয়াছেন। জননেতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এই ব্যাপারে সরকারকে হুশিয়ার করিয়া দেওয়া সত্ত্বেও তাহাদের এই নীরবতা সত্যিই দুঃখজনক। দেশের বুভুক্ষ জনসাধারণের এই করুণ অবস্থা প্রত্যেককেই অভিভূত করিয়াছে। জনদরদী মওলানা ভাসানী জনসাধারণের দুঃখে অভিভূত হইয়া খাদ্য সমস্যার সমাধানের দাবীতে শেষ পর্যন্ত অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন। বৃদ্ধ বয়সে তাহার এই অনশন স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিবে। তাহাছাড়া দেশের এই চরম দুর্দিনে বলিষ্ঠ ও সুষ্ঠু নেতৃত্বের একান্ত প্রয়ােজন। সেই নেতৃত্বের পুরােভাগে জনসাধারণ দেখিতে চায় তাহাদের প্রিয় নেতা মওলানা ভাসানীকে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মওলানা সাহেবকে বিশেষভাবে অনুরােধ জানাইতেছি যে, তিনি যেন অবিলম্বে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।