You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.02 | উত্তাল মার্চ ও ইতিহাসের মহানায়ক | আবুল মাল আবদুল মুহিত - সংগ্রামের নোটবুক
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া অতি দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিস্তৃত। সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭) যখন গৌড় রাজা বরেন্দ্র, রাঢ় ও সমতটকে একীভূত করলেন, তখনই শুরু হয় বাংলার ভৌগােলিক সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া। অষ্টম শতাব্দীতে (ভিন্নমতে দশমে) শুরু হয় বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিকাশের প্রক্রিয়া। বাংগালা’ নামের ব্যবহার শুরু হয় ১৩৪২ সালে, যখন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ হলেন শাহ-এ বাংগালিয়া’। হিন্দু, বৌদ্ধ, প্যাগান ও মুসলমান নিয়ে যৌগিক জাতিসত্তার উন্মেষ হয় ১৪৪৩ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হােসেন শাহের আমল থেকে। মােগল আমলে সপ্তদশ শতাব্দীতে শুরু হল বাঙালি সত্তায় খ্রিস্টান প্রভাব। ব্রিটিশ শাসনামলেই উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা দানা বাঁধতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১১) তা বেশ শক্তিশালী হয়। কিন্তু দুটি কারণে এই জাতিসত্তার দাবি যৌক্তিক রূপ পায়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আন্দোলনে সর্বভারতীয় সত্তা বাঙালি জাতিসত্তাকে চেপে রাখে এবং বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষক্রিয়া বাঙালি জাতিসত্তার ক্ষতিসাধন করে। তবুও ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বেংগল প্যাক্টের মাধ্যমে বীজটি জাগিয়ে রাখলেন। আবার একটি উদ্যোগ হল ১৯৪৭ সালে সংযুক্ত বাংলার সােহরাওয়ার্দী-বসু পরিকল্পনায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তানের অ্যুদয়ে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন তিরােহিত হল।
 
পাকিস্তানে দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল নিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ধারণা ছিল অত্যন্ত আগুয়ান ও সুসভ্য চেতনার বিমূর্ত প্রকাশ। কিন্তু এই আকাক্ষা শুরুতেই কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা গেল তীব্র প্রাদেশিকতা ও স্বার্থপর ব্যবহার। সেখানকার সংগঠিত জনবিচ্ছিন্ন জমিদার-আমলা-সেনাপতিদের এলিটের শাসন ও শােষণপ্রবৃত্তি একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করল। বিভক্ত দেশের। সর্বকর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হল পশ্চিমাঞ্চলের করাচি-পিণ্ডিতে। পূর্বাঞ্চলের অংশীদারিত্ব। মােটেই থাকল না অথচ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের (প্রথমে ৬৩ শতাংশ ও পরে মােহাজেরদের অংশগ্রহণের ফলে ৬৫ শতাংশ) বাসস্থান ছিল পূর্বাঞ্চলে। আরও দেখা  গেল, বিনিয়ােগের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা হল পূর্বাঞ্চালকে বাদ দিয়ে পশ্চিমে এবং সেজন্য। পূর্বাঞ্চলের বৈদেশিক সম্পদ বিপুলভাবে পশ্চিমে পাচার চলল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ পূর্ববাংলায় (পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন হল পূর্ব পাকিস্তান) এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ধারণা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্দোলন চালিয়ে গেল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম নতার মর্যাদা দিতে। এজন্য বাঙালিকে শাহাদত বরণ করতে হল। ভাষার দাবি জয়যুক্ত হলেও কিন্তু সাংস্কৃতিক অবদমনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রইল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এবং প্রশাসনে উগ্র প্রাদেশিকতা ও শােষণপ্রবৃত্তি পূর্বাঞ্চলকে অনবরত গরিব করে তুলল, আর বৈষম্য ক্রমেই বাড়তে থাকল। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে পূর্বাঞ্চলকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়ােগ থেকেও বঞ্চিত করা হল।
 
১৯৬৬ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ বাংলার স্বাধিকারের দাবি ছয়দফা কার্যক্রমে তুলে ধরল। বিশ্বসভ্যস্তায় অগ্রগতি সময় ও দূরত্বকে ক্রমে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছিল। এই পরিবর্ধন বিবেচনা করেই এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নজরে রেখে ছয়দফা কার্যক্রম দুটি স্বশাসিত ইউনিট নিয়ে একটি কনফেডারেশনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত প্রদান করে। অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী পাকিস্তানি সেনানেতৃত্ব এই ইঙ্গিতটি বুঝতেই পারল না। এবং উচ্চাভিলাষী ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদী পশ্চিমী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দুৰ্বত্ত সেনাবাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। এদের সম্মিলিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনাে বিকল্প রইল না। সংলাপের মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযােগ থাকল না। বিংশ শতাব্দীতে ১৯০৮ সালে নরওয়ে ও সুইডেনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। আবার ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিচ্ছেদ হয়। এই দুটি বিচ্ছেদই ছিল সংলাপ ও সমঝােতার ফসল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অ সব হল না সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের অশুভ চক্রান্তের ফলে। এবং সেজন্যই একাত্তরের মার্চ মাসে সমঝোতার যে স্বপ্ন জেগেছিল তা চুরমার হয়ে মার্চ হল স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত মাস। | বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সামনে সংসদ অধিবেশনের মুলতবি ঘােষণা দেখা দিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে। পূর্বাঞ্চলের জনগণ এটা মানতে মােটেও রাজি নয়। সেনাবাহিনী এই প্রতিবাদকে বিদ্রোহ বিবেচনা করার জন্য যুদ্ধংদেহী অবস্থানে রয়েছে। তিনি এই ঘােষণার প্রতিবাদ করলেন, ৩ মার্চ ডাকলেন ধর্মঘট ও জনসভা। ৩ মার্চ তিনি দেশব্যাপী অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণা দিলেন। তার দাবি হল তিনটি যথা—সামরিক শাসনের অবসান, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন। পরে চতুর্থ দাবি দিয়ে আন্দোলনকালে সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার। রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তার নির্দেশ হল—সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে তৎপরতা। তিনি আরও জানান, ৭ মার্চ তিনি পূর্ণ কার্যক্রম ঘােষণা দেবেন। 
 
ইতিমধ্যে এমহল স্বাধীনতার ঘােষণা দাবি করল। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন পতাকা উত্তোলন করল। উৎসাহ-উদ্দীপনা বজায় রাখার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণেরও মহড়া চলল। সারাদেশে পরিচালিত হল একটি অনন্য অসহযােগ আন্দোলন। প্রশাসন পুরােপুরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করতে শুরু করল। আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেশে শান্তিশৃখলার দায়িত্ব গ্রহণ কাল এবং রাতারাঝি তারা সব সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ করে দিল। বহু প্রতীক্ষিত ৭ মার্চে বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রে হল প্রথম বিদ্রোহ। সেনাবাহিনী হুকুম দিল, ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচার করা যাবে প্রতিবাদে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করল।
 
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ১৮ মিনিটে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ প্রদান করলেন। ৮ মার্চের মার্কিন প্রধান সংবাদপত্রে সেই ভাষণের বিবরণ পাওয়া গেল। চারটি প্রধান সংবাদপত্রে এই খবরের শিরােনাম ছিল নিম্নোক্ত
HCG. EP Leader stops short of declaration of independence. G ED Fight for litarty East Pakistan told বাল্টিমাের সান। East Pakistan Strikes Called. ASED New demands by the East Pakistan leader বিশ্বের অনেক মহান নেতা তাদের কোনাে-না-কোনাে ভাষণের জন্য বিখ্যাত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ বক্ততার জন্য বিখ্যাত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রুয়েলের খাজি হচ্ছে- “The only King we ha | M in fear itself” উক্তির জন্য। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডির বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে “Ask not what your country can do for you, ask what you can do for your country.” আফ্রোমার্কিন মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর বাণী হচ্ছে- “have a dream” ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিখ্যাত তার স্বাধীনতার প্রাপ্তিলগ্নে বক্তব্যের জন্য- “Long your ago we sea tryst with destiny”, স্যার উইনস্টন চার্চিল ছিলেন নামকরা বাগী এবং তার অসংখ্য বক্তৃতা জগৎবিখ্যাত। আমার বিবেচনায় ডানকার্কের পশ্চাদসরণ উপলক্ষে ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ বক্তব্য—’Never in the field of human conflict was so much owed by so many to so few. | বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ছিল নরম-গরম কথা। এতে ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য। বালির লড়াইয়ের কাহিনী। এতে ছিল অসহযােগ আন্দোলনের অন্য দিকনির্দেশনা। এতে ছিল আলােচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আহ্বান। এতে ছিল জনগণকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতির আহ্বান এবং সর্বশেষে এই ভাষণে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রচ্ছন্ন ঘােঘণা। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস এবং এখনও এই বক্তৃতা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে, উসাহিত করে আর করে আশান্বিত। এই বক্তৃতাকে বলা হয় সব কুল রক্ষা করে অসমসাহসী ভাষণ যা একেবারেই অতুলনীয় এবং এই ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা ও এর  ন্যায্যতা তুলে ধরে এবং গৃহযুদ্ধ বা একটি দেশের অন্তস্তরীণ বিষয় বলে তাকে অবহেলার সুযােগ রহিত করে। এই ভাষণের ফলেই মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী গ্রহণযােগ্যতা আহরণ করে।
 
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, সকাবের দশকে একটি দেশের অন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী আগ্রহ, যা হস্তক্ষেপ ছিল একেবারে নিষিদ্ধ এবং একই সঙ্গে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার মা তেমন চিন্তাবনা ছিল না। তদুপরি একটি দেশ সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রক্রিয় মােটেই গ্রহণযােগ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির মহাকবি (সাপ্তাহিক সাময়িকী Men’s wered তাকে এই খেতাব প্রদান করে। আর এই ভাষণে তিনি সৰ কুল Bক্ষা করে দেন একটি ঐতিহাসিক অদ্বিতীয় ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তাদের কাছে এ ভাষণ হিল উদ্দীপনা, প্রণােদনা, সাহস ও ভরসার স্থল। তাঁর বক্তৃতার শুরুতে ছিল বাংলাদেশের শ্বাশত লক্ষা: বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ প্রতিপক্ষের প্রতি ছিল সাবধানবাণী : সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত ভাষণের উপসংহারে বলেন, ‘এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে—বাঙালিরা বুঝেসুয়ে কাজ করে প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লা। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ রাজনীতির চারুশিল্পে ৭ মার্চের বড় ছিল অতি চমৎকার একটি ভাষণ। বাংলাদেশ বিচ্ছেদে জন্য যুদ্ধ শুরু করল না, বাংলাদেশ পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। ২৬ মার্চের কালাে রাতে যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হল তাকে প্রতিহত করতে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। সসম্মানে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে আলােচনা। করে সংকট সমাধানের চালটাও ছিল খুবই কুশলী পদক্ষেপ।
 
শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশ তাে শেষ মাইলটি পর্যন্ত গেল। বঙ্গবন্ধু একজন দক্ষ সেনাপতি ছিৰে মার্চের পঁচিশ দিনে সায়া জাতিকে স্বশীলনে প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা প্রদান করেন। অসহযােগ আন্দোলন সারাদেশে জনঞ্জীবনের রুটিন প্রবাহ বজায় রাখে আওয়ামী লীগের সর্বমােট ৫টি নির্দেশনা। সারাটি প্রশাসনযন্ত্র হয়ে যায় আৰ। বলা তা যে পাকিস্তানের অস্তিত্ব সে পচিশ দিন ছিল শুধু সেনাছাউনিতে সীমাবদ্ধ, সারাদেশে অনল ছিল বাঙালির স্বশাসন। এতে যে আত্মপ্রত্যয় বলব, হয় এবং স্বাধীনতার যে অভিজ্ঞতা মিলে, তাতে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া জাতির সামনে আর কোনাে বিকল্প ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ও মুক্ত এলাকা শাসনেও পঁচিশ দিনের অভিজ্ঞতা ছিল অতি মূল্যবান। অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনায় তাজউদ্দিনের নেতত্বে আঞয়ামী লীগ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে  আলােচনা করে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করে। সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
 
বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। তঁার পক্ষে হঠকারী বা অসম্মানজক কোনাে পদক্ষেপ কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মানসপুত্র। পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধের আশঙ্কা ছিল একান্তই একটি আষাঢ়ে গল্প। বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র বিপ্লবের কোনাে প্রস্তুতি বিবেচনাই করেননি। তার কৌশল ছিল জনগণকে চেতনায় সশস্ত্র করা। প্রতিরােধ ও স্বাধিকার এমনভাবে তাদের মনমানসে প্রােথিত হবে যে আত্মরক্ষার উপায় তারাই বের করে নেবে। একটি জাতি জাতির প্রতিবাদ কোনােমতেই অস্ত্রের জোরে বানচাল করা যায় বঙ্গবন্ধু এই শাশ্বত সত্যে বিশ্বাস করতেন। তাঁর কৌশলের সাফল্য ছিল দুটি ক্ষেত্রে এবং তার ফলে মুক্তিযুদ্ধে ব্যর্থতার কোনাে আশঙ্কাই ছিল না। প্রথমটি ছিল জনমনে তিনি সে স্বাধিকারের বাসনা জাগিয়ে দেন এবং প্রতিরােধে তাদের যে আত্মবিশ্বাস তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাতে তাদের অবদমনের কোনাে সুযােগ ছিল না। মাত্র লাখ পাঁচেক রাজাকার, আলবদর ও আলশামস ছাড়া আর কেউ হানাদার দস্যুদের সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। সেজনাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছাত্র, চাষি, জেলে, শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সবাই হয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধা। দ্বিতীয়ত, তিনি সার্থকভাবে প্রমাণ করেন যে, সমঝােতার কোনাে প্রচেষ্টা তিনি বাদ দেননি। পাকিস্তানি আক্রমণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার ইতিবাচক বার্তার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি আরও প্রমাণ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ঘােষণার জন্য তিনি কারও সঙ্গে কোনাে ষড়যন্ত্র করেননি। তিনি জনগণের দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বের সদিচ্ছার ওপরই ভরসা করে এগিয়ে যান। তার ন্যায্য অবস্থান, স্বচ্ছ ও উক্ত নেতৃত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মানুষের ক্ষমতায়নে তার নিবেদন ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এবং দুর্দান্ত সাহস তাকে এনে দেয় বিজয়ের আনন্দ। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত ও নির্জন কারাগারে বন্দি এবং সবরকম সংবাদ বা যােগাযােগ থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষটি নির্লিপ্তভাবে এবং নিয়ে ভার জনগণের ভালােবাসা ও দৃঢ়তার পর বিশ্বাস রেখে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন।
 
মার্চ আমাদের গৌরবের মাস। মার্চে আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। ১৯৪৮ সালে এই মার্চেই শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪-তে এই মার্চেই প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে গণবিরােধী মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়। ১৯৫৬ সালে মার্চেই বাংলাভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসেই আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ছয়দফা কার্যক্রম ঘােষণা করে ও বঙ্গবন্ধুকে দলের সভাপতি নির্বাচন করে। ১৯৬৯-এর মার্চেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় গােলটেবিল বৈঠক। আর একাত্তরের কাহিনী তাে আমরা এখানেই শুনলাম। ১৯৭২  সালে এই মার্চেই আমাদের মিত্রবাহিনী আমাদের ভূখণ্ড থেকে বিদায় নেয়। একাত্তরে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘােষণা আমরা দিই তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ বাহাত্তরের ১৫ মার্চেই চিরতরে রুদ্ধ হয়। যে শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহানায়কের নেতৃত্বে আমরা আমাদের জাতি রাই অবশেষে প্রতিষ্ঠা করলাম তারও জন হয় ১৯২০ সালে মার্চের সতেৱে তারিখ।
 
স্বাধীনতার সাইত্রিশতম বার্ষিকীতে আজ জাতি আছে এক মহাসংকটে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রায় দুঃসহ। সরকার চূড়ান্ত সমস্বয়হীনতায় দু। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি প্রশ্নবােধক। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গ্রাধিকার নির্ধারণ করতে সরকার একেবারেই অপারগ। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের খড়গহস্ত। সুপ্রসারিত। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘােড়া উৎপাদনে ধস এবং সরবরাহে অব্যবস্থা ও অপর্যাপ্ততার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনগণের সুখ-শান্তি অপহরণ করেছে। এক অদৃশ্য শক্তি যেন ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবতাবোধ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। সরকার একেবারেই গণবিচ্ছিন্ন। এই বিপর্যয় থেকে উত্তরণের পথ এই মার্চেই খুঁজতে হবে। প্রথমেই উন্মুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সচল করতে হবে, রাজনীতিকে বিতাড়ন করার অশুভ উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে হবে। আত নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অনতিবিলম্বে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে হবে। স্বাধীনতার মাসে আমার প্রত্যাশা=গােষ্ঠীস্বার্থ এবং গােপন রাজনৈতিক এজেন্ডা দেশপ্রেমের কাছে পরাজয় মেনে নেবে। আবারও আমরা আওয়াজ তুলব : জয় বাংলা এবং জয় বঙ্গবন্ধু।
 
যুগান্তর ২৬ মার্চ ২০০৮
সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী